শিশুর Speech Delay বা দেরীতে কথা বলা | ফরিদা আখতার

শিশুর কথা বলা:

সাধারণত ২০ মাস বয়সের মধ্যে শিশু দুই শব্দের ছোট ছোট বাক্য বলতে শিখে যায়। যেমন- বাবা আস, মাম দাও, পাখি যা। যদি এই বয়সের মধ্যে অস্পষ্টভাবে হলেও এটুকু না বলতে পারে তবে এটাকেই বলি delay speech বা দেরীতে কথা বলা। দু একটা শব্দ বলতে পারছে মানে একসময় বাকীগুলোও বলবে কিন্তু delay speech এর কারণে শিশুর অন্য development গুলোতেও এলোমেলো লেগে যায় এবং সেগুলোও ব্যাহত হয়। তাই এটাকে একেবারে ignore করার আসলে সুযোগ নেই। সে তো কথা বলতে পারছে না অর্থাৎ সে নিজের চাহিদাগুলোকে প্রকাশও করতে পারছে না সঠিকভাবে। এর কারণে তার আচরণে কিছুটা রুক্ষতাও চলে আসে এবং মেজাজী হয়ে যায়। একটুতেই দেখবেন বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে আর আনন্দটা হারিয়ে ফেলছে।

নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন সময়ে ভিজিট করা শিশু বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ এবং এতদিনকার পড়া বিভিন্ন আর্টিকেল ও দেখা বিভিন্ন চিকিৎসা সংক্রান্ত টিভি অনুষ্ঠানের তথ্যের উপর ভিত্তি করে যতটুকু মনে আছে তাই লিখছি। সাধারণত সহজ ভাষায় লিখতে চেষ্টা করি সবকিছু। আমার কোথাও ভুল হলে ধরিয়ে দিবেন আর অস্পষ্টতা থাকলে প্রশ্ন করবেন প্লিজ।

Delay_speech_হলে_করনীয়ঃ

আমরা কথা বলি মূলত brain দিয়ে। এই brain টাকে stimulate করেই ওকে দিয়ে কথা বলাতে হবে। এই stimulation টা আসলে কি? সহজ বাংলা করলে দাঁড়ায় আলোড়ন, উত্তেজনা, আগ্রহ, উৎসাহ, উদ্যম জাগানো, কৌতূহলী করা। চলুন দেখি কিভাবে এই stimulation টা করতে পারি আমরা।

১৷ দিনের মধ্যে চারবার রুটিন করে শিশুর সাথে কথা বলুন এবং খেলুন। প্রতিবার আধা ঘন্টা করে। সকাল-দুপুর-বিকেল-রাত। এই সময়টুকুতে টিভি/ মোবাইল সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ রাখুন। পূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে শিশুকে এবং আপনাদের মা ও শিশুর সম্পর্কটাকে।

(সবাই আপনাকে বলবে সারাদিন শিশুর সঙ্গে কথা বলুন। এটা আসলে অবাস্তব একটি কথা। সারাদিন কখনো একজন মানুষের পক্ষে কথা বলাটা সম্ভব হয় না। আপনার নিজস্ব ব্যক্তিগত কাজ থাকবে, রান্নাবান্না, গোসল, ঘুম, খাওয়া, বিশ্রাম থাকবে। তাছাড়া সারাদিন পিছে পড়ে থাকলে শিশুও বিরক্ত হতে পারে আর আপনি কী করছেন এতে শিশু আর গুরুত্ব দিবে না।)

২৷ সহজ কিছু ছড়া- যেমন: আতা গাছে তোতা পাখি, চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে, আয় আয় চাঁদ মামা, আয়রে আয় টিয়ে, ঐ দেখা যায় তালগাছ- এগুলো নিজে মুখস্ত করে রাখুন আর স্পষ্ট উচ্চারণে ছন্দের তালে তালে, হাসিমুখে, আনন্দের সাথে শোনান। গোমড়া মুখে যাই বলেন না কেন ওর কাছে আকর্ষণীয় হবে না ফলে সে আগ্রহীও হবে না।

৩৷ সহজ কিছু শিশুতোষ গান যেমনঃ আমরা সবাই রাজা, আমরা করবো জয়, ঝড় এলো এলো ঝড়- এমন ছোট ছোট সহজ শব্দের গান বাছাই করে সুরে সুরে গাইবেন। উপরের ছড়াগুলোও গানের সুরে গাইতে পারেন।

(ছড়া-গানের ভাষা যেন খুব সহজ আর ছোট ছোট শব্দের হয়। নির্দিষ্ট সংখ্যক ছড়া/গান-ই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইবেন। ধরুন ১০-১২ টা। তাহলে ওর brain মনে রাখতে পারবে শব্দগুলোকে। ইংরেজি/বাংলা মিশিয়ে ছড়া বলা বাদ রাখতে হবে। এমনকি হিন্দী/ইংরেজি কার্টুন/সিরিয়ালও ওর সামনে দেখা যাবে না। এতে শিশু confused হয়ে যায়। কারণ আমরা বাসায় বাংলা ভাষার ব্যবহার করি। আশেপাশে অনেকগুলো ভাষার ব্যবহারে তার বিভ্রান্তি বেড়ে যাবে আরো। এতে speech আরো delay হয়ে যাবে। এইসব গুলো কথাই delay speech এর শিশুদের জন্য প্রযোজ্য। স্বাভাবিক কথা বলা শিশুদের বেলায় পূর্ণ স্বাধীনতা আছে অনেককিছু শোনানোয়।)

৪৷ শিশুর সাথে লুকোচুরি খেলুন, দরজার পেছনে, পর্দার আড়ালে, আলমারির কোনায়। সিরিয়াসলি খেলবেন এবং আপনি নিজেও এনজয় করবেন। শক্ত একটা ওড়না অথবা একটা বেডশীট দুই ভাঁজ করে দুই প্রান্ত দুজন বাবা-মা ধরে দোলাবেন আর শিশু মাঝে দোল খেতে থাকবে। বাবা-মা দুজনে এই সময়ে আনন্দ করুন, হাসুন, ছড়াও পড়তে পারেন- দোল দোল দুলনি। পরিবেশটা আনন্দের হলে শিশুও মুহূর্তটাকে এনজয় করবে। বল খেলুন, প্লাস্টিকের ক্রিকেট স্ট্যাম্প আর বল পাওয়া যায়, কিনে এনে দিন। ওকে বল মারতে দিন, আপনি ব্যাট করুন। ওর সাথে খেলুন। রঙ বেরঙের বেলুন পাওয়া যায়। বাসায় এনে ছেড়ে দিবেন। সবাই মিলে বেলুন ছোঁয়ার খেলা খেলতে পারেন।

৫৷ শিশুকে প্রচুর হাসতে দিন। আপনি নিজেও হাসুন। দুষ্টুমি করুন, মজা করুন। কথা বলুন খুব আদুরে ভঙ্গিতে, মুখে হাসি রাখবেন সবসময়। শিশুর সাথে সকল ব্যবহার করবেন অত্যন্ত আদবের সাথে। আমি কিন্তু মজা করছি না একদম। খাওয়ানো, জামা পরানো থেকে শুরু করে এমনকি কোনকিছু নিষেধ করার সময়েও সম্মানের সাথে কথা বলুন। সবার আত্মসম্মানবোধ আছে। তাচ্ছিল্যের সাথে কখনো দূর দূর করবেন না। মন ছোট হয়ে যায়। এমনিতেই তো ছোট্ট মানুষ, ছোট্ট মন, আরো ছোট হয়ে গেলে কি থাকে বলুন!

৬৷ এটা সবচেয়ে important issue। যদি শিশুর বাবা থাকেন তবে অবশ্যই তার সাথে রোমান্টিক হোন। হাত ধরে কথা বলা, পাশে বসা, খাইয়ে দেওয়া, জড়িয়ে ধরা এগুলো করুন। শিশু দেখবে তার সবচেয়ে আপণ দুজন মানুষ একে অপরের বন্ধু। শিশুর নিরাপত্তার বোধটা শক্ত হয়, জীবনের প্রতি আস্থা দৃঢ় হয়। বাবামার কলহে শিশুর নিজেকে অস্তিত্বহীন মনে হয়। ভিতরের সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যায়। এটাতো হতে দেওয়া যাবে না। শিশুর বাবাকে ভালোবাসুন, তার ভালোবাসা আদায় করে নিন, শিশুর সামনে পারস্পরিক ভালোবাসা প্রকাশ করুন। আমাদের দেশের এক আজব নীতি, প্রকাশ্যে মারামারি করা যায়, গালিগালাজ করা যায়, কিন্তু প্রকাশ্যে ভালোবাসা প্রকাশ করা যায় না! So weird!

৭৷ সামাজিকতার সাথে পরিচিত করাতে হবে। নিকট আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যান। বিশেষ করে যেখানে ছোট শিশু আছে। আপনি একশবার বললেও যা ওকে stimulate করবে না তা একটা ছোট্ট শিশু একবার করলেই হবে। স-বা-ই নিজেদের গোত্রের সাথে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে ☺।

৮৷ পাশের, নীচের, উপরের ফ্ল্যাটের মানুষদের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলুন। হালকা খাবার পাঠান, গল্প করুন গিয়ে। দশ মিনিটের interaction এরও গুরুত্ব অনেক।

৯৷ শিশুর বাবাকে দিয়ে শিশুকে নীচে পাঠাবেন। সব সময়ই সেখানে কিছু শিশু ছুটোছুটি করে। আড়ালে থেকে বাবা-শিশু দেখবে। নিরাপদ পরিবেশ হলে ছেড়েও দেওয়া যায়। সবার সাথে নিজেই পরিচিত হবে। চাই কি সেসব শিশুদের চকলেটও মাঝেমধ্যে কিনে দিতে পারেন।

১০৷ ঘুরতে যাবেন। কিন্তু এমন দূরত্বে যাবেন না যেখানে ভ্রমনটাই না আবার অসুস্থ করে ফেলে। আপনি যদি মিরপুরে থাকেন তবেতো আমি আপনাকে রমনা পার্কে যেতে বলবো না, সেক্ষেত্রে বোটানিক্যাল গার্ডেন বা চিড়িয়াখানা হবে আপনাদের জন্য বেস্ট অপশন। বিশাল একটা খোলা জায়গায় দৌড়ানোর সুখটা সে পাবে। প্রকৃতির স্পর্শে যে অবারিত আনন্দ তা সে বুঝতে শিখুক।

১১৷ শিশুকে রঙিন ক্লে কিনে দিন। হরেক রকম জিনিস নিজে বসে থেকে বানান একসাথে। তা না পেলে অন্তত ময়দা মেখে নিন রুটি বানানোর মতো করে। তা দিয়ে সাপ, বল বিভিন্ন জিনিস বানান। বা পিড়ি বেলুনে রুটিও বানাতে দিতে পারেন। রং পেন্সিল দিতে পারেন, সে আঁকবে হিজিবিজি। রঙিন কাগজ কিনে প্রজাপতি, নৌকা এগুলো ইউটিউব দেখে একসাথে বসে বানান। তারপর নৌকা ভাসিয়ে দিন, প্রজাপতি উড়িয়ে দিন।

১২৷ শিশুরা সাধারণত লম্ফঝম্প, নাচানাচি পছন্দ করে। গান গাইতে গাইতে নাচুন ওর সাথে।

১৩৷ শিশুর বাবার ভূমিকা এখানে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ওনাকে সময় দিতে উৎসাহিত করুন, অনুরোধ করুন, আদেশ করবেন না কখনো প্লিজ। বাবার সাথে মিশলে শিশুরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে গড়ে ওঠে।

১৪৷ মোবাইল/টিভি/বিজ্ঞাপন যত কম দেখতে দিবেন ততই ভালো। আমেরিকায় নাকি আইন করে তিন বছরের শিশুদের টিভি দেখা নিষেধ করেছে। টিভি বেশি দেখলে শরীরের ওজন বেড়ে যায়।

১৫৷ delay speech এর শিশুদের যখন আড়াই বছর বয়স হবে তখন প্রি স্কুলে দিবেন। যেমন- ড্রয়িং বা গানের স্কুল, ডে কেয়ার সেন্টার, কিন্টারগার্ডেন। স্কুলে বলে নিবেন আপনার উদ্দেশ্য।

১৬৷ শিশুতোষ বই কিনে দিন, বাবা-মা-শিশু একসাথে পড়তে বসুন। আপনারা আনন্দ নিয়ে পড়বেন, ও আগ্রহী হয়ে শুনবে। ছোট ছোট গল্প করুন, গল্প শোনান। আপনাদের কন্ঠস্বরের আদর, স্নেহ, আনন্দ, উচ্ছ্বাস সবকিছুই বোঝে শিশুরা 💑।

১৭৷ ঘরের কাজের জন্য আপাতত বুয়া রাখুন প্রয়োজনে দুজন। যদি ফিক্সড সাহায্যকারী পেয়ে যান সে তো আরো ভালো। ওর সাথে শিশুকে মিশতে দিবেন। বেবিও খুশি হবে ওর সাথে খেলতে পেয়ে।

১৮৷ খেলনার দোকানে টকিং টম বলে একটা খেলনা বিড়াল পাওয়া যায়। যা বলা হয় সে তাই প্রতিধ্বনি করে। এতেও শিশুর কথা বলার আগ্রহ জন্মাতে পারে।

১৯। খুব ভালো হয় যদি এক সপ্তাহের জন্য দাদাবাড়ি/নানাবাড়ি/ মামাবাড়ি থেকে ঘুরে আসা যায়। হঠাৎ করে এক ঝাঁক নতুন মানুষের সাথে মিশবে, খেলাধূলা করবে, সমবয়সী শিশুদের সাথে লাফালাফি, ছোঁয়াছুঁয়ি খেলবে, কথা বলা শুরু করার আগ্রহ খুব বেশি হবে তার এবং অবাক হয়ে খেয়াল করবেন যে কথা বলাও শুরু করছে। মোবাইল, গেমস, টিভি সব ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনাও খুব বেশি। এরপর ফিরে এসে দেখবেন মোবাইল ছাড়াই খাবার খাচ্ছে।

২০৷ সর্বোপরি নিজেকে ভালোবাসুন। নিজের যত্ন নিন। নিজেকে যতক্ষণ না ভালোবাসতে পারছেন ততক্ষণ পৃথিবীকে ভালোবাসার আশা দুরূহ। কাউকে কিছু দিতে হলে তো তা নিজের মধ্যে থাকতে হবে আগে।

মনে রাখবেন,শিশু জন্ম নিয়েছে আমাদেরই মাধ্যমে, ও দেশ ও জাতির সম্পদে পরিনত হোক অথবা ব্যক্তি ও পরিবারের বোঝা হিসেবে থাকুক, দুভাবেই সবকিছুর দায় আমাদেরই নিতে হয়। সুতরাং, সন্তানের বেড়ে ওঠার শুরুটাই হোক আমাদের মননশীলতার নিবিড় পর্যবেক্ষনে।

ভালো থাকুন। আনন্দে থাকুন। 💙🌿

লেখাঃ

ফরিদা আখতার
শিশুদের দিনলিপি 👨‍👩‍👧‍👦

6 Shares:
Leave a Reply
You May Also Like
Read More

শিশুর পরিপূরক খাবার কিভাবে শুরু করবেনঃ

মায়েদের_জিজ্ঞাসাঃ কিভাবে সলিড দেয়া শুরু করবোঃ নতুন মায়েদের সবচেয়ে কমন যেই জিজ্ঞাসা তা হলো, ছয় মাস বয়সী বাচ্চার…
Read More

ছোট্ট শিশুর চোখের সমস্যা

ছোট্ট_শিশুর_চোখের_সমস্যাঃ Congenital_Nasolacrimal_duct_obstrucrion: ১০ দিন বয়সের শিশুটি মায়ের কোলে চড়ে চেম্বারে এসেছিলো, তার অসুবিধা ছিলো জন্মের পর থেকেই বাম…
Read More

★শীতে শিশুর ব্রংকিওলাইটিস★

শীতে শিশুর ব্রংকিওলাইটিসঃ  ব্রংকিওলাইটিস ভাইরাসজনিত একটি রোগ। জীবাণু হলো আরএসডি ভাইরাস। তবে ইনফ্লুয়েঞ্জা-পেরা ইনফ্লুয়েঞ্জা, এডিনো, রাইনো ও মাইকোপ্লাজমাও…