

মেয়েদের জরায়ু পেলভিক ফ্লোরের লিগামেন্ট এবং পেশী দ্বারা শ্রোণীগুলির মধ্যে তার দৃঢ় অবস্থানে থাকে। তবে, যখন এই লিগামেন্ট ক্ষতিগ্রস্থ হয়, প্রসারিত বা দুর্বল হয়ে জরায়ুটি যোনিতে নেমে জরায়ু প্রলাপস হতে পারে।
জন্মগত ও জন্মের পরের কিছু কারণে এই মাংস ঝুলে যেতে পারে। বয়সের সাথে স্বাভাবিক ভাবেই ইস্ট্রোজেন হরমোনের ঘাটতি হতে থাকে। তখন অনেক মহিলার জরায়ু মুখ যোনির দিকে নেমে আসে। যার ফলে প্রলাপস হয়।
জরায়ু নিচে নেমে যাওয়া বা ইউটেরাইন প্রলাপ্সের কারণসমূহঃ
১. জন্মগতঃ কখনো কখনো যেসব মাংস পেশি জরায়ুকে সঠিক স্থানে ধরে রাখে ,কারো কারও ক্ষেত্রে জন্মগত দুর্বলতা থেকে থাকতে পারে।
২. জন্মের পরঃ জন্মের পরের বলতে এক্ষেত্রে আমরা সন্তান ধারণের সময়টাকেই বুঝি । সন্তান জন্মধারণের পরে বেশ কিছু কারণে প্রলাপস হতে পারে। জরায়ুমুখ সম্পূর্ণ রকমে খোলার আগেই যদি চাপ দেয়া হয়, অতিরিক্ত টানাটানির কারণে হতে পারে। ডেলিভারি বিলম্বিত হলে, প্লাসেন্টা বের করার জন্যে জরায়ুতে নিচের দিকে অতিরিক্ত চাপ দিলে।
অনেক বেশি সন্তান ধারণের ফলে হয়। মা খালাদের মধ্যে যাদের চার-পাঁচটা নরমাল ডেলিভারি হয়েছে খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের প্রায় সবারই একটু হলেও এই সমস্যাটা আছেই। ডেলিভারির পরে ভারী কাজকর্ম করার ফলেও এমন হতে পারে। তাই নরমাল না সিজারিয়ান যেভাবেই ডেলিভারি হোক ডেলিভারির পর পরই ভারী কাজকর্ম করা উচিত নয়।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে মাংস পেশি দুর্বল হয়ে যায় এবং ইস্ট্রোজেন হরমোন কমে আসতে থাকে। মেনোপজের পরে হরমোনাল সাপোর্টের অভাবও একটি বড় কারণ।
দীর্ঘদিন ধরে পেটে চাপ পড়ার মত রোগ যেমন – কাশি , কোষ্ঠকাঠিন্য , পেটে পানি জমে থাকলেও এমন হতে পারে।
অতিরিক্ত ওজন থাকলে পেটের উপর চাপ পড়ে এবং স্বাভাবিক ভাবে পেটের মাংস পেশির উপর ও চাপ পড়ে। ভারী জিনিস ওঠা নামা করালে পেটে চাপ পড়তে পারে। পেলভিসে বড় কোন অপারেশন হলেও সাপোর্ট কমে গিয়ে প্রলাপস হয়ে থাকে । কারো জরায়ুতে বড় টিউমার না ফাইব্রয়েড হলেও প্রলাপস হতে পারে।
জরায়ু প্রলাপসের লক্ষণগুলো কি কিঃ
- যোনি থেকে দৃশ্যমান কিছু বের হয়ে আসছে,
- যোনি থেকে কিছু ঝুলে আছে এমন অনুভূতি,
- মনে হবে যেন পেটের ভিতরটা ভরে আছে বা চাপ অনুভব করবেন ঠিক যেন ছোট্ট একটি বলের উপর বসে আছেন,
-কোমড়ে ভারী বোধ হওয়া,
-চাপ, ভারী হওয়া এবং যোনিতে একটি টানটান সংবেদন, - পিঠে ব্যাথা,
-হাঁটতে কষ্ট হওয়া, - মল ও মূত্রত্যাগের অসম্পূর্ণতা,
- যৌন মিলনে ব্যথা পাওয়া।
জরায়ু নিচে নেমে আসলে গর্ভকালীন সময়ে নিম্নলিখিত জটিলতার কারণ হতে পারেঃ
-সময়ের আগে বাচ্চা হয়ে যাওয়া বা প্রি-টার্ম লেবার
- প্রসবকালীন জটিলতা
-জরায়ুতে অস্বস্তি - জরায়ুতে ঘা
-মূত্রনালীর সংক্রমণ - প্রস্রাব করতে সমস্যা বা রিটেনশন
- ভ্রূণ এবং মায়ের সেপসিস
-প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণ জরায়ু প্রলাপ্সের জটিল ক্ষেত্রে ভ্রূণের গর্ভপাত ঘটতে পারে। প্রসবের পরেও জটিলতা দেখা দিতে পারে।
প্রলাপ্স এর ক্ষেত্রে জরায়ু কোন অবস্থানে আছে তার উপর নির্ভর করে তিন ভাগে ভাগ করা হয় একে। চলুন এ নিয়ে জেনে নেই আরো বিস্তারিত।
প্রলাপসকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় –
১. প্রথম ডিগ্রিঃ জরায়ু মুখ তার স্বাভাবিক অবস্থান থেকে কিছুটা নিচে নেমে আসে। কিন্তু যোনি ছিদ্রের বাইরে অবস্থান করে না।
২. দ্বিতীয় ডিগ্রিঃ জরায়ু মুখ যোনি ছিদ্রের বাইরে বের হয়ে আসে। কিন্তু জরায়ুর শরীরের বেশির ভাগ অংশই ভিতরে থেকে যায়। সবসময় বেরও হয়ে আসে না। কাশি দিলে, প্রস্রাব করতে গেলে বের হয় আসে। এমন কি বের হলেও হাত দিয়ে ঢুকিয়ে ফেলা যায়।
৩. তৃতীয় ডিগ্রিঃ জরায়ু মুখ তার শরীরসহ সম্পূর্ণ রূপে বাইরে বের হয়ে আসে এবং আর ভিতরে ঢুকানো যায় না ফলে প্রস্রাব ও পায়খানা করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এই স্টেজে গেলে অপারেশন করা অতিশয় জরুরী হয়ে দাঁড়ায়।
প্রলাপস সাধারণত একা হয় না, আরও কিছু সমস্যা এক সাথে হয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তোলে । যেমন-
Cystocele – মুত্রথলির একটি অংশ যোনির সামনের দিকের অংশে চাপ দিয়ে ফুলিয়ে তোলে। কাজেই প্রস্রাবে জ্বালা পোড়া, ঘন ঘন প্রস্রাব, প্রস্রাব আটকে থাকা সহ বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে।
Enterocele – খাদ্যনালীর একটি অংশ ( ক্ষুদ্রান্ত্রের ছোট অংশ ) যোনির সামনের দিকের অংশে চাপ দিয়ে ফুলিয়ে তোলে । দাঁড়িয়ে থাকলে টান লাগার মত অনুভূতি এবং পিঠে ব্যথা হয়। শুয়ে থাকলে ব্যথা কমে আসে।
Rectocele – রেক্টাম যোনির দেয়ালের পিছনের অংশে চাপ দিতে পারে। ফলে পায়খানা করতে সমস্যা হয়। ক্ষেত্র বিশেষে যোনির ভিতরে আঙ্গুল দিয়ে রেক্টাম ঠেলে সরিয়ে পায়খানা করতে হয়।
কখন ডাক্তারের কাছে যাওয়া জরুরী?
উপরের যে কোন সমস্যা অনুভব করে থাকলে এবং বিশেষ করে যদি জরায়ু মুখ, আংশিক বা সম্পূর্ণ জরায়ু বেরিয়ে আসলে।
চিকিৎসাঃ
মাংস পেশি কতটা দুর্বল সেটার উপর নির্ভর করে অপারেশন করা লাগবে কি না। অনেক ক্ষেত্রে এক্সারসাইজ করলে পেলভিক মাংসগুলো আবার শক্তিশালী হয়। ইস্ট্রোজেন ক্রিম বা সাপোজিটরি অনেক ক্ষেত্রে মাংস পেশির শক্তি ফিরে আনতে সাহায্য করে। তবে খেয়াল রাখতে হবে এটি মেনপজের পরেই ব্যবহার করা যায় এবং সবাইকে দেয়াও যৌক্তিক নয়।
বাচ্চা নিতে ইচ্ছুক কিনা তার উপর নির্ভর করে জরায়ুর আশেপাশের কাঠামো ঠিক করা এমনকি জরায়ু সম্পূর্ণরূপে ফেলে দিতে হতে পারে। সাধারণত পেট কেটে জরায়ু ফেলা হয়। কিন্তু যোনি দিয়ে জরায়ু বেরিয়ে আসলে যোনিপথেও অপারেশন করা হয়। পাশাপাশি যোনি দেয়াল, মুত্রথলি, মূত্রনালির ঝুলে পড়াও অপারেশনের সময় ঠিক করে দেয়া হয়।
প্রলাপস না হবার জন্য করণীয় কিঃ
- প্রোটিন,ফ্যাট ও কার্বোহাইড্রেট এর সঠিক সমন্বয়ে পরিমিত খাবার ও যথেষ্ট পানি গ্রহণ করা উচিত যাতে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য এড়িয়ে চলা যায়।
-নিয়মিত কিছু এক্সারসাইজ করার অভ্যাস থাকা উচিত।
- দীর্ঘদিনের পুরনো কাশি ও কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে অবশ্যই চিকিৎসা করানো উচিত।
-নিয়মিত পেলভিক ফ্লোরের ব্যায়াম যেটাকে কিগেল এক্সারসাইজ বলে তা করা উচিত।
***কিভাবে কিগেল এক্সারসাইজ করবেনঃ
আপনার মূত্রথলি খালি অবস্থায় বসে বা শুয়ে এই ব্যয়ামটি করতে পারবেন।
আপনার পেলভিক ফ্লোরের(প্রস্রাব ও পায়খানার রাস্তার আশেপাশের) মাংসপেশীগুলো শক্ত করুন। শক্তভাবে ধরে থাকুন এবং ৩ থেকে ৫ সেকেন্ড গণনা করুন।
পেশী শিথিল করুন এবং ৩ থেকে ৫ সেকেন্ড গণনা করুন।
এভাবে ১০ বার করে দিনে ৩ বার পুনরাবৃত্তি করুন (সকাল, বিকাল, এবং রাতে)
আপনি যখন এই অনুশীলনগুলি করবেন তখন গভীর শ্বাস নিন এবং আপনার শরীরকে শিথিল রাখুন। নিশ্চিত হয়ে নিন যে আপনি নিজের পেট, উরু, নিতম্ব বা বুকের পেশী শক্ত করছেন না।
এই ব্যয়ামটি কিন্তু সকলেরই করার অভ্যাস থাকা উচিত। এতে অল্প বয়সে জরায়ু ঝুলে যাওয়া, হাসলে বা কাশি দিলে ফোঁটায় ফোঁটায় প্রস্রাব ঝরা, পায়খানা কষা থাকায় মাংস অল্প বের হয়ে আসা এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
- ভারী কোনো কাজ করার সময় সঠিক পদ্ধতিতে করা উচিত যাতে পেটে অতিরিক্ত চাপ না পরে।
-প্রেগন্যান্সি ও ডেলিভারির পরে অবশ্যই বিশ্রাম করা উচিত, ভারী কাজ করা উচিত নয়।
- ধুমপানের অভ্যাস থাকলে ত্যাগ করা উচিত যাতে ক্রনিক কাশির সমস্যা না হয়।
আমাদের দেশের বয়স্ক মহিলারা এই সমস্যায় বেশি পড়েন। তাদের মধ্যে অনেকেই অবহেলা ও অযত্নের আশঙ্কায় বলতে চায় না কাউকে এমনকি নিজের পরিবার থেকেও অনেক সময় লুকিয়ে রাখে। আপনার কাছের কেউ যদি এই রোগে ভুগে থাকেন তবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। অনেক বয়স হয়ে গেলেও বড় কোন শারীরিক সমস্যা না থাকলে অপারেশন করা যায়। বয়স হয়ে গিয়েছে ভেবে অবহেলা করা উচিত নয়। শেষ বয়সে এসে প্রস্রাব, পায়খানার কষ্ট কেউই চায় না। সচেতনতাই স্বস্তি। আতঙ্কিত হবেন না যেহেতু জরায়ু প্রলাপসের কারণে চরম জটিলতা এবং সমস্যাগুলি সাধারণত যখন পরিস্থিতি উপেক্ষা করা হয় তখন ঘটে। জরায়ু প্রলাপসের লক্ষণগুলি আরও খারাপ হওয়ার আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
ডাঃ তাজরীন জাহান
MBBS, CCD, CMU
Advisor of 20 Minute Medical