প্যারেন্টিং – স্বতন্ত্র একটি মানুষকে গড়ে তোলার মহান দায়িত্ব, নিঃসন্দেহে চ্যালেন্জিং। এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে যেয়ে হিমশিম খাওয়া, ক্লান্ত লাগা, হতাশ হয়ে পড়া, খেই হারিয়ে ফেলা, মন খারাপ হওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। বিশেষ করে শিশু সন্তানটি বড় হওয়ার সাথে সাথে তার আচরণগত বিষয়গুলো ম্যানেজ করা বেশ চ্যালেন্জিং। অনেকেই এই বিষয়ে জানতে চান।নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কথা শেয়ার করলাম, আশা করি উপকৃত হবেন :
💌 সবার প্রথমে মন থেকে স্বীকার করে নিতে হবে সন্তান মানেই বাবা মায়ের নিজস্ব সম্পত্তি নয়। সে সম্পূর্ণ আলাদা একজন সত্বা, তার নিজস্ব এমন কিছু বৈশিষ্ট থাকবেই যেগুলো অপরিবর্তিত, সেই বৈশিষ্টগুলোর জন্যই সে স্বতন্ত্র একজন মানুষ। আমাদের দায়িত্ব সন্তানকে বদলানোর চেষ্টা করা নয়, আমাদের দায়িত্ব তার জীবনযাপন সহজ ও সুন্দর করে দেওয়া। তার শাসক নয় বরং সাহায্যকারী হওয়া।
💌 অনেকেরই শিশু সন্তানকে ঘিরে সাইলেন্ট এক্সপেক্টেশন থাকে – সে হবে নাদুস নুদুস পুতুলের মত, যা দেওয়া হবে তাই খাবে, সময়মত ঘুমাবে, বাবা মায়ের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে, খুব বুঝে শুনে দুষ্টুমি করবে, সব কিছুতে দক্ষ হবে, সবাইকে ছাড়িয়ে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি আরো অনেক কিছু। আমাদের অবচেতন মনে এসব স্বপ্নের পাহাড় গড়ে ওঠে আর শিশুটি যখন ন্যাচারালি শিশুসুলভ আচরণ করে তখনই আমরা তা মেনে নিতে পারিনা, অস্বাভাবিক লাগে এবং দ্রুত ভালো ফল দেখতে চাই। আমরা ভুলে যাই আমাদের কাজ শিশুকে দিয়ে নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করানো নয়, বরং আমাদের কাজ তাকে স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করা।
💌 রাগ/জিদ/মারামারি – ডেভেলপমেন্টের অংশ হিসাবে ছোট্ট শিশুরা এসব আচরণ করে থাকে যা আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণে না আসলে পরবর্তীতে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। বাবা মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা নিজেরা রোল মডেল না হলে এই সমস্যার আর কোন সমাধাণ কার্যকরী হবেনা। প্যারেন্টসরা যারা এধরণের সমস্যায় ভুগছেন তারা যেকোন মূল্যে নিজেদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করুন, চিৎকার চেচামেচি, মারধোর বন্ধ করুন, দেখবেন ম্যাজিকের মত কাজ হবে।শিশুর আচরণ নিয়ণ্ত্রন করা মানে তাকে ফোর্স করে স্টপ করা নয়, বরং সে নিজেই যেনো তার ইমোশন কন্ট্রোল করতে পারে সেই পদ্ধতি শেখানো, তার কাছে ভালো আচরণের উদাহরণ হলে তবেই এটা সম্ভব।
💌 অনেকেই বলেন সন্তানের সাথে ভালো আচরণ করেও তাকে কথা শোনাতে পারেননা। ভালো আচরণের সত্যিই কোন বিকল্প নেই, এতে কাজ না হওয়ার বিশেষ কিছু কারণ থাকতে পারে – ১) আপনার কথা সন্তানের কাছে যথেষ্ট যুক্তিসংগত মনে হয়না ২) আপনি ৯০% সময় খুব ভালো আচরণ করেও শেষ ১০% হয়তো এতটাই খারাপ করে ফেলেন যা বাকি ভালোটুকুকে ছাপিয়ে ফুটে ওঠে। ৩) কোন কারণে হয়তো সন্তানের সাথে ইমোশনাল কানেকশন তৈরি হয়নি তাই সে আপনার ইমোশনের গভীরতা বুঝতে ব্যর্থ। পরিবারের সবাই মিলে রেগুলার কোয়ালিটি টাইম কাটানো ও সন্তানের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা এক্ষেত্রে রেমিডি বলা যায়, ভীষণ কার্যকর।
💌 শিশুর কাছে আমাদের এক্সপেক্টেশন তার বয়স ও ডেভেলপমেন্ট অনুযায়ী হয় কি? আমরা হয়তো তাকে এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করে কথা বলি যা তার বোধগম্য নয়, যে বিষয়ে কথা বলি তার প্রকৃত অর্থ হয়তো সে তখনো বোঝেনা। সমবয়সী অন্য অনেকে বুঝলেও তার আরো কিছুটা সময় লাগতে পারে । শিশু প্রকৃতপক্ষে কি বুঝতে পারছে বা পারছেনা তা বোঝা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
💌 শিশুকে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা দিন তবে সেই সাথে বাউন্ডারি এবং লিমিটেশন সেট করে দিতে হবে। তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট যত শক্তিশালী হবে সে তত পুশ করে নিজেকে প্রমাণ করতে চাইবে। এক্ষেত্রে আমরা প্যারেন্টসরা দুই ধরণের ভুল করি – ১) রেগে গিয়ে খারাপ ব্যবহার করে ফেলি ২) বেশি নরম হয়ে প্রথমে না বলেও পরে হ্যা বলে ফেলি। আসলে এই দুটোর কোনটাই করা যাবেনা বরং উল্টোটা করতে হবে। প্রথমে না বললে তা আর হ্যা করা যাবেনা কিন্তু রেগে নয়, উচ্চস্বরে নয়, ভারি গলায় এমনভাবে কথা বলতে হবে যেনো যা বলছেন তা মিন করেন।
💌 বাউন্ডারি সেট করা সব শিশু পছন্দ করেনা। অনেকেই হতাশ হয়ে ব্যাকফায়ার করে। তখন আমরা শিশুর কষ্ট দেখে কষ্ট পাই। মন চাইলেও তো সব সময় সন্তানকে আনন্দ দেওয়া বাস্তবে সম্ভব নয়। তার মনোকষ্ট দূর করার সবচেয়ে সহজ উপায় তার মনের কথা শুনতে চাওয়া, তার দুঃখের কথা শোনা মানেই তার সব আবদার সাপোর্ট করা নয়, বরং সমব্যথী হতে না পারলেও তার ব্যাথাকে সম্মান জানানো। এটা করলে শিশু আত্নবিশ্বাসী হয় এবং স্ট্রেস ম্যানেজ করতে শেখে। “আমি খুবই সরি তুমি মন খারাপ করেছো কিন্তু এখন তো আমি তোমাকে খেলনাটা কিনে দিতে পারবোনা কারণ আমার কাছে পর্যাপ্ত টাকা নেই / তোমার অতিরিক্ত প্রয়োজন নেই” কেবল এই কথাগুলো বলে বলে যে বাচ্চা বায়না করে শপিং মলে শুয়ে পড়ে তাকেও ঠিক করা সম্ভব।
💌 শিশুকে কোন কিছুতে বাঁধা দিলে তার কারণ বুঝিয়ে বলুন, তৎক্ষণাৎ না হলেও পরে বলুন কিন্তু বলুন। সে যেনো বুঝতে পারে এমন ভাবে বলুন, আপনি যে গায়ের জোরে তাকে বাঁধা দিচ্ছেননা, বিশেষ কিছু কারণে দিচ্ছেন সেই কারণগুলো তাকে বোঝান। একটা সময় সে আপনার ‘না’ বলাকে মন থেকে মেনে নিবে।
💌 যেসব শিশু অযাচিত আচরণ করে তার পেছনে সবসময় কোন না কোন কারণ থাকে যেগুলো আমরা বুঝতে ব্যর্থ হই। বকা দিয়ে, মার দিয়ে তাদের সাময়িক ভাবে চুপ করানো গেলেও প্রকৃত সমাধাণ পাওয়া সম্ভব নয়। এতে বরং শিশুরা নিজেদের গুটিয়ে ফেলে, বাবা মায়ের সাথে মানসিক দুরত্ব তৈরী হয়। এক সময় এত বড় গ্যাপ তৈরী হয় যে সন্তান তার বাবা মাকে জড়িয়ে ধরতেও দ্বিধান্বিত হয়, কাছে থেকেও খুব দূরের কেউ হয়ে যায়।
💌 অনেকেই বলেন ছোটবেলায় বাবা মায়ের মার খেয়ে তারা আশীর্বাদপুষ্ট, কোন কিছু মনে রাখেননি, তাদের কোন সমস্যা হয়নি, বরং মানুষ হয়েছেন – এরকম আরো অনেক পজিটিভ ফিডব্যাক। কিন্তু তারা কি জানেন যে ছোটবেলার মারধোর একটা মানুষকে প্রতি পদে পদে ভোগাতে পারে? আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, অনুভূতি প্রকাশের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে মাথা তুলে দাড়াতে ভয় পাওয়া, ফ্যামিলি ও স্যোশাল লাইফ মেইনটেইন করতে না পারা, নিজেকে অন্যের চেয়ে ছোট করে দেখার প্রবণতা, অন্যের প্রতি অমানবিক হওয়া – এমন বহু কন্সিকিউয়েন্সেস যা পুরো লাইফ সাইকেল জুড়ে ছড়িয়ে থাকে। এগুলো আমার ব্যক্তিগত কথা নয়, রিসার্চের কথা। তেমন কার্যকরী হলে তো উন্নত বিশ্বে আমাদের দেশের মারপিটের কালচারকে মডেল হিসাবে ব্যবহার করতো।
💌শিশুদের সাথে খারাপ ব্যবহার না করেও তাদের ভালো মন্দ শেখানো যায়, বরং অনেক ভালোভাবেই শেখানো যায়। হয়তো একটু সময়সাপেক্ষ, ধৈর্য নিয়ে চেষ্টা করতে হয় তবে খুব কার্যকরী হয়। মারধর করতে নিষেধ করার অর্থ এই নয় যে শিশুর ভুল আচরণ কে প্রশ্রয় দিতে উৎসাহিত করছি। যা অন্যায় ও অনুচিত তা সবার বেলাতেই অন্যায় ও অনুচিত।
💌সুস্থ, সুখী ও পজিটিভ প্যারেন্টিং এর জন্য সবার আগে নিজের চিন্তা ভাবনা ও আচরণ উন্নত করতে হবে। বিভিন্ন পদ্ধতি এপ্লাই করে দেখতে হবে শিশুর জন্য কোনটি উপযোগী। ধারাবাহিক ও আন্তরিক চেষ্টা থাকতে হবে। শিশুকে কন্ট্রোল করতে চাইলে কোন পদ্ধতিই কার্যকরী হবেনা। নিজের ও শিশুর সাইকোলজি খুব ভালো করে বুঝতে হবে। শিশুর কাছ থেকে বড় মানুষের মত আচরণ আশা করা যাবেনা।
আজকাল সবার একই অভিযোগ মাথা গরম হয়ে যায়, ফ্যামিলি প্রবলেম, কেউ সাপোর্ট করার নেই, দেশে নানা রকম সুযোগ সুবিধার অভাব – এসব কারণে মায়েরা শিশুর ওপর চড়াও হয়ে যান, ভালো প্যারেন্টিং করা সম্ভব হয়না।
সবকিছু মানলাম, আপনাদের কোন সুযোগ সুবিধাই নেই। কিন্তু চিন্তাশক্তিও কি নেই? উপরে যা কিছু লিখেছি তার প্রতিটি অভিজ্ঞতা আপনাদেরও আছে। আপনারা মন দিয়ে ভাবেননা তাই সুস্থ সমাধান মাথায় আসে না, আপনাদের মাথা কেবল গরমই হয়। যে সন্তানকে কষ্ট করে দশ মাস পেটে ধরেছেন তার ওপর রাগ না ঝেড়ে সংযত থাকার জন্য আপনাদের এনাফ কারণ প্রয়োজন হয়, সুযোগ সুবিধা প্রয়োজন হয়। আফসোস!
সন্তানের প্রতি সদাচরণ করার জন্য কেবল মা হওয়াই কি যথেষ্ট বড় কারণ নয়।
মানুষ মাত্রই ভুল হয়, আমারও অনেক ভুল ত্রুটি আছে। তবে আমি শোধরানোর চেষ্টা বন্ধ করিনা। যারা নিজেদের ভুল স্বীকার করে সমাধানের চেষ্টায় এগিয়ে আসেন তাদের সত্যিই মন থেকে সম্মান করি, ভালোবাসা জানাই।💌❤️
আরাফাহ্।💕
ছবির বয়স ( ২ বছর ৫ মাস )
পারভীন ববি
শিশুদের দিনলিপি👨👩👧👦