ভিটামিন ডি এর স্বল্পতায় ভুগছেন না তো !?

গড়পড়তা একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের দৈনিক ১ হাজার মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম ও ৬০০ ইউনিট ভিটামিন ডি লাগে। নারীদের এবং সত্তরোর্ধ্ব পুরুষদের দরকার হয় একটু বেশি ক্যালসিয়াম, ১ হাজার ২০০ মিলিগ্রাম। গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েরও লাগে একটু বেশি। সঠিক নিয়মে সূর্যালোক ও ভিটামিন ডি–সমৃদ্ধ খাবার নিয়মিত গ্রহণ করলে এর ঘাটতি সহজেই মেটানো যায়। এর ফলে হাড় ক্ষয় রোধসহ ভিটামিন ডি-জনিত অন্যান্য রোগ থেকে সহজেই মুক্ত থাকা যায়।

ক্যালসিয়াম হাড় শক্ত করে, এটা আমরা জানি। আর ক্যালসিয়াম শরীরে শোষণ করে কাজে লাগাতে দরকার হয় ভিটামিন ডি। ভিটামিন ডির অভাবে শিশুদের রিকেট রোগ হয়। শিশুদের পা ধনুকের মতো বেঁকে যায় এবং মাথার খুলি বড় হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে এই রোগে ভুগলে শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা কমে যায়। ভিটামিন ডির অভাবে চোয়ালের গঠন ঠিক হয় না, অসময়ে দাঁত পড়ে যায়।

বড়দের অস্টিওম্যালেসিয়া নামে একপ্রকার রোগ হয়। এই রোগে বয়স্কদের হাড় থেকে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস ক্ষয় হয়ে পড়ে। কখনো কখনো কোমরে ও মেরুদণ্ডে বাতের ব্যথার মতো ব্যথা অনুভূত হয়। অনেক ক্ষেত্রে মেরুদণ্ড বেঁকে যায়।
গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়ের এই রোগ বেশি হতে দেখা যায়।

🔘ভিটামিন ডি এর উৎস?

সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি ভিটামিন ডির অন্যতম উৎস। সূর্য যখন প্রখর থাকে, তখনই অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে পৌঁছায়। তবে কাচ, ঘন মেঘ, কাপড়চোপড়, ধোঁয়া ও সানস্ক্রিন এই রশ্মিকে বাধা দেয়।

তৈলাক্ত মাছ, যেমন কড বা হাঙর মাছের যকৃতের তেল এবং অন্যান্য প্রাণীর যকৃতেও প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। এ ছাড়া দুধ, ডিমের কুসুম, মাখন ও চর্বিযুক্ত খাদ্যে ভিটামিন ডি থাকে। যেসব প্রাণী মাঠে চরে বেড়ায় এবং প্রচুর সূর্যালোক পায়, ওই সব প্রাণীর দুধ, ডিম ও যকৃতে ভিটামিন ডির পরিমাণ বেশি থাকে।

ভিটামিন ডি চর্বিতে দ্রবণীয় একটি ভিটামিন। এটি সুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খুব অল্প সংখ্যক খাবারই ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। যেসব খাবারে ভিটামিন ডি পাওয়া যায় সেটি আমাদের দেশের দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় খুবই কম থাকে। যেমন- তৈলাক্ত মাছ, কিছু কিছু উন্নত প্রজাতির মাশরুম, কলিজা প্রভৃতি ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার। তবে সূর্য থেকে সবচেয়ে বেশি ভিটামিন ডি শরীরে তৈরি হয়। অর্থাৎ সূর্যই হলো ভিটামিন ডি-র সবচেয়ে ভালো উৎস।
সূর্যরশ্মি ভিটামিন ডি তৈরি করতে যেমন সহায়ক, তেমনই অতিরিক্ত ভিটামিন ডি ধ্বংস করতে ভূমিকা রাখে। তাই শুধু সূর্যরশ্মি থেকে মাত্রাতিরিক্ত ভিটামিন ডি শরীরে জমানোর আশঙ্কা নেই বললেই চলে। অর্থাৎ শরীরে অতিরিক্ত ভিটামিন ডি জমার কারণ প্রধানত অতিরিক্ত পরিমাণ ভিটামিন ডি খাওয়া। শিশুদের ক্ষেত্রে ভিটামিন ডি ইনজেকশন, ক্যাপসুল অথবা বিভিন্ন রকম খাদ্যে ভিটামিন ডি যুক্ত করে (ভিটামিন ডি ফর্টিফায়েড) খাবার খেয়ে অতিরিক্ত ভিটামিন ডি দেহে জমা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

🔘সূর্যালোক থেকে ভিটামিন ডি পর্যাপ্ত পরিমাণে পেতে কোন সময় গায়ে রোদ লাগাবেন?

আলোয় বেরিয়ে যখন দেখবেন আপনার ছায়া আপনার তুলনায় ছোট, তখনই সেই আলোতে আপনার ত্বক সবচেয়ে বেশি ভিটামিন ডি তৈরি করতে পারবে। বলা হয় সকাল ১০টা থেকে দুপুর ৩টা হলো ভিটামিন ডি নেয়ার ভালো সময়।

  • যারা শ্যামবর্ণ, তাদের ত্বকে মেলানিন নামের রঞ্জক উপাদান বেশি। আর যারা ফরসা, তাদের ত্বকে এই উপাদান কম থাকে। মেলানিন অতিবেগুনি রশ্মিকে বাধা দেয়। ফরসা লোকজনের প্রতিদিন ২০ মিনিট রোদে থাকলেই চলে।
  • অতিবেগুনি রশ্মি কাচ ভেদ করতে পারে না। তাই গাড়ি বা ঘরের ভেতর জানালা বন্ধ অবস্থায় রোদ এলেও লাভ নেই, পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি মিলবে না।
  • পোশাক ও সানস্ক্রিন ত্বকে সরাসরি ভিটামিন ডি লাগতে বাধা দেয়। তাই আপাদমস্তক ঢেকে বেরোলে চলবে না। অন্তত হাত-পা বা মুখের কিছু অংশ খোলা রাখুন। মাঝেমধ্যে সানস্ক্রিন ছাড়াই রোদে বেরোতে হবে।
  • বয়স বাড়তে থাকলে ত্বকের ভিটামিন ডি তৈরি করার ক্ষমতা কমতে থাকে। আর বয়স্কদেরই কিন্তু হাড় ক্ষয়ের সমস্যা বেশি। তাই বয়স হয়েছে বলেই সারা দিন বাড়ি বসে থাকা ঠিক নয়। নিয়মিত বের হবেন এবং গায়ে রোদ লাগাবেন।
  • দূষিত বায়ু, ধোঁয়া ইত্যাদি অতিবেগুনি রশ্মিকে শুষে নেয় বা প্রতিফলিত করে। তাই দূষিত শহরে থাকলে মাঝেমধ্যে একটু দূরের গ্রামে বা আউটিংয়ে যাওয়া উচিত।

🚫ভিটামিন ডি এর অভাবে দেহে যেসব সমস্যা হয়ঃ

ভিটামিন ডি দেহের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এর অভাবে শরীরে নানা অসুবিধা হতে পারে। ঘন ঘন রোগ অথবা সংক্রমণ, অবসাদ, হাড় ও কোমর ব্যথা ইত্যাদি। ভিটামিন ডির অভাবে যেসব সমস্যা হয় সেগুলো নিচে দেওয়া হলো :

⭕ঘন ঘন রোগ অথবা সংক্রমণ হওয়া
ভিটামিন ডি শরীরে পর্যাপ্ত না থাকলে ঘন ঘন সর্দি-কাশি হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন ডির অভাবে শ্বাসতন্ত্রে ঘন ঘন সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া ভিটামিন ডি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি ঘন ঘন সংক্রমণ ছাড়াও নানা রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে।

⭕অবসাদ ও ক্লান্ত হওয়া
অনেক গবেষণায় দেখা গেছে ভিটামিন ডির সঙ্গে কম বয়সীদের অব্সাদগ্রস্ত হওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। যাদের রক্তে ভিটামিন ডি অপর্যাপ্ত থাকে তারা একটুতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন।

⭕হাড়ব্যথা ও কোমরব্যথা
ভিটামিন ডি দেহের হাঁড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন ডি শরীরে ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন ডির অভাবে হাড়ে ও কোমরে ব্যথা হয়ে থাকে। বিশেষ করে একটু বয়স্ক নারীদের। সুতরাং রক্তে ভিটামিন ডির অভাবে হাড়ে ও পিঠে ব্যথা হয়ে থাকে।

⭕বিষণ্ণতা
ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা অনেকের ক্ষেত্রেই ভিটামিন ডির ঘাটতির একটি লক্ষণ। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যারা বিষণ্ণতায় ভুগছে, তাদের রক্তে ভিটামিন ডি যথাসম্ভব প্রদান করতে পারলে বিষণ্ণতা অনেক কমে যায়।

⭕ঘা বা ক্ষত শুকাতে না চাওয়া
যেকোনো আঘাত বা অপারেশন হলে যদি রক্তে ভিটামিন ডির ঘাটতি থাকে, তবে তা সহজে ভালো হতে চায় না। কেননা ভিটামিন ডির যথেষ্ট ভূমিকা থাকে ইনফেকশনের বিরুদ্ধে কাজ করে ক্ষতস্থান দ্রুত সারিয়ে তুলতে।

⭕হাড় ক্ষয়
ভিটামিন ডি রক্তের ক্যালসিয়াম শোষণ ও হাড়ের বিপাকের জন্য জরুরি একটি পুষ্টি উপাদান। মেনোপোজের পর বেশির ভাগ নারীর হাড় ক্ষয় হয়ে যায়। যাদের মধ্যে বেশির ভাগই ভিটামিন ডির অভাবের কারণ। হাড়ের ক্ষয় মূলত ভিটামিন ডির অভাবের জন্য হয়ে থাকে।

⭕চুল পড়া
চুল অনেক কারণে পড়তে পারে। কিন্তু চুল পড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে ভিটামিন ডিকেও দায়ী করা হয়ে থাকে।

⭕মাংসপেশির ব্যথা
ভিটামিন ডির অভাবে শিশু ও প্রাপ্ত বয়স্ক যেকোনো বয়সীদেরই মাংসপেশিতে ব্যথা হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক শিশু আছে যাদের ভিটামিন ডির ঘাটতি থাকে। তাদের মাংসপেশিতে ব্যথা হয়।

⭕ঘাটতি হলে কি করবেনঃ

ভিটামিন ডি-র ঘাটতিতে খুব দ্রুত কোনো শারীরিক লক্ষণ দেখা দেবে না। বিভিন্ন রকম শারীরিক সমস্যা নিয়ে শিশু-কিশোরদের বা বড়রা চিকিৎসকদের কাছে যেয়ে থাকেন।

রক্তের সিরামে ভিটামিন ডি-র মাত্রা পরিমাপ করা হয়। একজন হরমোন বিশেষজ্ঞ বা অন্য কোনো চিকিৎসক যখন রোগীর দেহে ভিটামিন ডি-র ঘাটতি সন্দেহ করলে তার রক্তের ভিটামিন ডি পরিমাপ করে সে অনুযায়ী কম থাকলে সাপ্লিমেন্ট দিবেন পাশাপাশি সূর্যের আলোতে থাকতে হবে ও ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হবে।

তবে ভিটামিন ডি ঘাটতি ও পরবর্তী চিকিৎসা পদ্ধতি ঠিক করার জন্য রক্তের ক্যালসিয়াম, প্যারাথাইরয়েড হরমোন ও ফসফরাসের মাত্রাও দেখে নিতে হয়।

ডাঃ তাজরীন জাহান
জেনারেল ফিজিশিয়ান এন্ড Advisor
20 Minute Medical

1 Shares:
Leave a Reply
You May Also Like
Read More

ফার্স্ট এইড বক্স

★★প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয় উপকরণ:ফার্স্ট এইড কিট★★ বিপদ কখনো বলে কয়ে আসেনা। তাই সাবধানতার অংশ হিসেবে প্রতিটি বাড়িতেই ফার্স্ট…
Read More

হার্নিয়া কথোপকথন (A-Z প্রশ্নোউত্তর)

হার্নিয়া কথোপকথনঃ জাহিদুল হাসান কিরনঃ শরীরের অপেক্ষাকৃত নরম মাংসপেশি যখন শরীরের বাইরে বেরিয়ে আসতে চায় তখন তাকে চিকিৎসা…