লিউকোরিয়া বা সাদা স্রাব হচ্ছে নারীদের একটি বিশেষ সমস্যা। অধিকাংশ স্রাব জীবন শৈলী ও শারীর বৃত্তীয় সংক্রান্ত যার কোন চিকিৎসা প্রয়োজন হয় না।
সাধারণত, স্বাভাবিক স্রাব পাতলা এবং সামান্য চটচটে হয়। এটা অনেকটা সর্দির মত।
🔵সাদা স্রাব বা লিউকোরিয়া হওয়ার কারণসমূহ কী?
০১. স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয়
– বয়সন্ধিকালে রক্ত চলাচল বেড়ে যায় ফলে নিঃসরণ-ও বেশি হয়
– যৌন মিলনকালে
– যৌন আবেগে
– গর্ভাবস্থায়
– শরীরের রাসায়নিক সমতা বজায় রাখতে এবং যোনির কোষগুলোকে সচল রাখতে oestrogen হরমোনের প্রভাবে এটি নিঃসৃত হতে পারে।
– মেয়ে শিশুর জন্মের প্রথম ৭-১০ দিনের মধ্যে এটি হতে পারে। মায়ের শরীরে যদি অত্যধিক হরমোন থাকে তবেও এটি হতে পারে।
– সন্তান ডেলিভারির প্রথম কয়েকদিন-ও সাদা স্রাব বেশি হতে পারে
– হস্তমৈথুন বা মাস্টারবেশন
– অভুলেশন ( ডিম্বাণু নিঃসরণ কালে ) বা জন্ম বিরতিকরণ পিল ব্যবহার করলে। কাজেই প্রথমে ভয় না পেয়ে দেখুন ও বুঝে নিন আপনার সাদা স্রাব কি অত্যধিক কিনা বা স্বাভাবিক কিনা। তারপর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিন।
০২. রোগ সম্বন্ধীয়
– মানসিক অশান্তি
– পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও পুষ্টির অভাব
– বিভিন্ন ধরনের কৃমির সংক্রমণ
– অপরিচ্ছন্নতা এবং কাপড় সঠিক ভাবে না শুকিয়ে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে রাখলে
– ইনফেকশন – যক্ষা, ছত্রাক (candida)
– জন্ম বিরতিকরণ পিল বা জন্মনিয়ন্ত্রণ খাবার বড়ি খাওয়া
– ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ
– পেটের নিম্নভাগের প্রদাহ
– STD (sexually transmitted disease)
-ডায়াবেটিস,কিডনি রোগ বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে বা স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ নিয়মিত সেবন করলে বার বার অতিরিক্ত সাদা স্রাব যেতে পারে।
বয়ঃসন্ধির আগে এবং স্থায়ী ভাবে মাসিক বন্ধ হবার পরে নিঃসরণ বেড়ে যেতে পারে। কারণ এ সময় সংক্রমণের আশংকা-ও বেশি থাকে। যদি স্রাবের সাথে রক্ত যায়, অথবা অতিরিক্ত নিঃসরণ হয় কিংবা অতি দুর্গন্ধ হয় তবে তা আশংকাজনক। বাচ্চা হওয়ার পর দুর্গন্ধ যুক্ত নিঃসরণ ( lochia ) এটাই নির্দেশ করে যে , জরায়ু তার গর্ভ ধারণের পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি। ছত্রাকের সংক্রমণ হলে সাদা দুধের ছানার মত নিঃসরণ যেতে পারে। পাশাপাশি চুলকানো ভাব থাকলে এটি আরও বেশি ছত্রাকের প্রতি নির্দেশ করে।
🚩তাহলে চলুন অস্বাভাবিক লক্ষন গুলো জানা যাকঃ
🗨মাসিকের সময় ছাড়া যদি পুরো মাস জুড়ে সাদা স্রাব যায় তাহলে তা অস্বাভাবিক।
🗨সাদা স্রাব যাওয়ার সময় পেটে বা কোমরে ব্যাথা।
🗨সাদা স্রাব থেকে দুর্গন্ধ বের হওয়া।
🗨সাদা স্রাব যাওয়ার সময় মাসিকের রাস্তায় চুলকানি হওয়া।
🗨সাদা স্রাব যাওয়ার সময় মাসিকের এবং প্রসাবের জায়গায় জ্বালাপোড়া করা।
🗨সাদা স্রাবের সাথে লালচে লালচে রং এর স্রাব বের হওয়া ইত্যাদি।
🗨তলপেট ভারি হয়ে থাকা
🗨 শরীর দুর্বল লাগা।
🗨চোখের নিচ গর্ত হয়ে যাওয়া, চোখের নিচ কালো হয়ে যাওয়া।
🗨 বদ হজম।
🗨চেহারার কোমলতা নষ্ট হয়ে যাওয়া।
প্রধানত এই সব লক্ষন গুলো দেখা দিলে অবশ্যই আপনার সাদা স্রাব যাওয়াটা স্বাভাবিক নয়।
এর জন্য আপনার ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।সময় মতো চিকিৎসা না নিলে এটি বড় বড় রোগের দিকে এগোতে থাকবে।
🌿অতিরিক্ত সাদা স্রাব গেলে কী করবেন —-🌿
সাদাস্রাবের প্রধান কারন হল ইনফেকশন। মহিলাদের জরায়ু “ওপেন অরগ্যান” বা উন্মুক্ত অংগ গুলোর মধ্যে একটি। যেহেতু জরায়ু উন্মুক্ত থাকে, তাই যে কোন ভাবে এইখানে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
মলদ্বার বা পায়ুদেশ থেকে জীবানু এসে খুব সহজেই জরায়ুতে সংক্রমণ হতে পারে।
সাদা স্রাব যাওয়ার খুব কমন একটা কারণ হচ্ছে ফাঙ্গাল ইনফেকশন। দুধ ফেটে গেলে যেমন ছানা ছানা হয়ে যায়, তেমনি ফাঙ্গাল ইনফেকশন হলে সাদা স্রাব সেভাবে ছানা ছানা অাকারে বের হয়। একই সঙ্গে প্রচন্ড চুলকাবে লজ্জাস্থানে। চুলকাতে চুলকাতে অনেক সময় চামড়া উঠে যায়। এক্ষেত্রে আমরা ( ডাক্তার) ফাঙ্গাসের ট্রিটমেন্ট দিই ও রোগী ভাল হয়ে যায়।
★★ প্রতিরোধ 👇👇👇👇👇
- যোনি পথ এবং আশেপাশের পরিবেশ দুটোই পরিষ্কার রাখতে হবে। যৌনাঙ্গ মাঝে মাঝে হালকা কুসুম গরম পানি দিয়ে মুছতে হবে।
- প্রতিদিন গোসল করতে হবে এবং কড়া রোদ অথবা ইস্ত্রির মাধ্যমে কাপড় শুকাতে হবে যাতে জীবাণু বংশবৃদ্ধি করতে না পারে।
- নিয়মিত ব্যায়াম ও শাক সবজি, ফল মূল ও পর্যাপ্ত পানি খেতে হবে।
- দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন যাপন করতে হবে৷
- দুর্বল স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে হবে৷
- জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ির কারণে হলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বন্ধ রাখতে হবে৷
- সহবাসের সময় স্বামীকে অবশ্যই কনডম ব্যবহার করতে হবে৷
- সাদাস্রাব যাওয়া অবস্থায় কোন প্রকার সহবাস করা যাবেনা।
- এই রোগের চিকিৎসা (বিবাহিত হলে) স্বামী স্ত্রী দু’জনকে একসাথে করতে হবে। কেননা স্বামীর নিকট থেকে পরবর্তীতে আবার স্ত্রীর ইনফেকশন হতে পারে।
- যদি যৌন বাহিত হয়ে থাকে তবে সুস্থ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত সহবাস থেকে বিরত থাকতে হবে।
- সহবাসের পর যেসব মহিলাদের লালচে বা গোলাপি স্রাব হয়, তাহাদের খুব শীঘ্রই ডাক্তারের নিকট যাওয়া উচিৎ। এমনকি যদি দু’টি পিরিয়ডের মাঝখনে গোলাপি ডিসচার্জ হয় তাহলেও ডাক্তার দেখাতে হবে। যদি পিরিয়ডের মাঝামাঝি সময়ে পানির মত পাতলা স্রাব হয়, তাহলে ভয়ের কিছু নাই।
- রক্ত মিশ্রিত,খয়েরি বর্ণের বা অতি দুর্গন্ধ যুক্ত হলে দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
-ডায়াবেটিস থাকলে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
- পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম এবং বিশ্রাম করতে হবে।
- মাসিকের সময় স্যানিটারী প্যাড বা পরিষ্কার কাপড় (ডেটল বা সেবলন) দিয়ে কিংবা ভালভাবে সাবান দিয়ে পেন্টি বা কাপড় জীবানুমুক্ত করে তা ব্যবহার করতে হবে।
- যৌনাঙ্গের অভ্যন্তরীণ টিউমার থাকলে তার চিকিৎসা করতে হবে।
- অন্তর্বাস পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে৷
★★ জীবন যাত্রায় পরিবর্তন 👇👇👇👇👇👇👇
- রাতে কম পক্ষে ৬-৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে।
- রাত জাগা যাবে না।
- ফাস্ট ফুড পরিহার করতে হবে।
★★ সাদাস্রাব এর জন্য ডায়েট 👇👇👇👇👇
- প্রতিদিন ২ চামচ টক দই খান।
- ভাজাপোড়া খাওয়া একদমই বাদ দিতে হবে।
- অ্যালার্জি যুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে।
- জিংক, মিনারেল ও আয়রন জাতীয় খাবার খাবেন।
-শারিরীক চাহিদা অনুযায়ী যথেষ্ট পানি পান করুন।
অস্বাভাবিক সাদা স্রাব জরায়ুর মুখের ক্যান্সারের কারণও হতে পারে। অতিরিক্ত সাদা যাওয়া। এই সাদা স্রাবের ধরনটা হয় চাল ধোয়া পানির মতো নোংরা।
এই স্রাবটা প্রচন্ড দুর্গন্ধযুক্ত হয়। এটা তখন এতো বেশী পরিমাণ যায়, টিস্যু বা প্যান্টি কোন কিছু দিয়ে একে আটকে রাখা যায়না। এ অবস্থায় চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখেন, তার জরায়ুর মুখে টিউমার বা এমন কিছু আছে কি-না।যদি খালি চোখে কিছু দেখা না যায় তখন তাকে পেপস নামক একটা টেস্ট করতে বলা হয়। এই টেস্ট বলে দেয় তার জরায়ুতে ক্যান্সারের কোন পূর্ব লক্ষণ আছে কি-না।
জরায়ুর মুখের ক্যান্সারের একটা পূর্বধাপ আছে। এই অবস্থায় যদি ধরা পড়ে এবং ঠিক মতো চিকিৎসা হয় তাহলে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এজন্য যখনই সাদা স্রাব যাবে, দেখতে হবে এটা কী স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক। সব সময় অস্বাভাবিকটা মাথায় রেখেই স্বাভাবিকটার চিকিৎসা করতে হবে।
সর্তকতাই হতে পারে আমাদের সুস্বাস্থ্যের কারণ।
💝💝💝
ডাঃ তাজরীন জাহান
MBBS, CCD, CMU
ADVISOR,
20 MINUTE MEDICAL