হার্নিয়া কথোপকথন (A-Z প্রশ্নোউত্তর)

  • হার্নিয়া কথোপকথনঃ

জাহিদুল হাসান কিরনঃ শরীরের অপেক্ষাকৃত নরম মাংসপেশি যখন শরীরের বাইরে বেরিয়ে আসতে চায় তখন তাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় হার্নিয়া বলা হয়। আমাদের পেটের কিছু অংশ আছে যেগুলো আশেপাশের অংশ থেকে দুর্বল হয় ৷ অনেকের জন্মগতভাবেও এই অংশগুলো দুর্বল থাকে ৷ পেটের ভিতরের চাপ যদি বেশি হয়, যেমন অনেক দিনের পুরনো হাঁচি, কাশি বা কোষ্ঠকাঠিন্যর ক্ষেত্রে হয়ে থাকে,তাদের ক্ষুদ্রান্ত্র এই দুর্বল অংশগুলো দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে৷ কুঁচকিতে হার্নিয়া হতে পারে ৷ এটা সাধারণত পুরুষদের হয় ৷

মহিলাদের উরুর ভেতরের দিকে ফুলে যায়৷ নাভির চারপাশে বা কোনো একপাশেও ফুলে যায় অনেক সময়ে৷ এটাকে নাভির হার্নিয়া বলা হয়৷ আগে অপারেশন করা হয়েছে এমন জায়গাতেও হার্নিয়া হতে পারে অথবা সিলাই এর জায়গার আশেপাশে৷ এটাকে ‘ইনসিশনাল হার্নিয়া’ বলা হয়৷ ভারী জিনিস তুলতে গিয়েও হতে পারে হার্নিয়া৷ পুরুষদের প্রস্টেটের অসুখ, ইউরিনারি ব্লাডারের অসুখের কারণে হতে পারে৷ চাপ দিয়ে টয়লেট করলে হতে পারে ৷ মহিলাদের ক্ষেত্রে ডেলিভারির পর ভারী কাজ বা অনবরত সিঁড়ি ভাঙলে হার্নিয়া হতে পারে ৷ চাপ দিয়ে টয়লেট করলে হতেপারে

সাদিয়া বেগমঃ হার্নিয়া হচ্ছে সেটা কী ত্বক/কোন লক্ষণ দেখে বোঝা সম্ভব?

জাহিদুল হাসান কিরনঃ হাঁটাচলা করলে, ভারী জিনিস তুললে বা জোরে হাঁচি-কাশি হলে কুঁচকির ওপরের দিকটা গোলাকার বলের মতো ফুলে ওঠে এবং শুয়ে থাকলে এটা চলে যায়। মাঝে মধ্যে শক্ত হয়ে যায় এবং ব্যথা হয়। কিছুদিন এভাবে চলার পর গোলাকার ফোলাটি স্ক্রোটামে (অণ্ডকোষ থলিতে) নেমে আসে এবং শুয়ে থাকলে আপনা আপনি পেটের ভেতর চলে যায়।ফোলা অংশটি বড় হতে থাকে এবং মাঝে মধ্যে চাপ দিয়ে ভিতরে ঢোকাতে হয়। তারপর ক্রমে চাপ দিলেও পেটের ভেতরে ঢোকে না। এ রোগের একমাত্র চিকিৎসা হলো অপারেশন।

সাদিয়া বেগমঃ মহিলা এবং পুরুষের ক্ষেত্রে কতটা তফাৎ হয় হার্নিয়ার?

জাহিদুল হাসান কিরনঃ হার্নিয়া ছেলে মেয়ে যে কারও হতে পারে। পুরুষের ক্ষেত্রে অন্ডকোষ বা স্ক্রোটাম, মহিলাদের ক্ষেত্রে উরুর ভেতরের দিকে মাংসপেশি ফুলে গেলে হার্নিয়া হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা যায়। মেয়েদের সাধারণত ব্যায়ামের অভ্যাস কম থাকায় তাদের পেটের পেশীগুলো সহজে নরম হয়ে ঝুলে পড়ে। তা থেকেই হার্নিয়ার শুরু হয়। অনেক ক্ষেত্রে সন্তান জন্ম দেওয়ার পরে, বিশেষত সি সেকশনের পরে হার্নিয়ার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

সাদিয়া বেগমঃ কত রকমের হার্নিয়া হতে পারে, তা কী কী?

জাহিদুল হাসান কিরনঃ হার্নিয়া কয়েকধরণের হতেপারে যেমন:

ইংগুইনাল হার্নিয়া: এটা নারী পুরুষ উভয়েরই হতে পারে দাঁড়িয়ে থাকলে, ভারী জিনিস তুললে বা জোরে কাশলে, হাঁচলে। আবার শুয়ে পড়লে কমে যায়।

ফেমোরাল হার্নিয়াঃ এটারও একই উপসর্গ, তবে পুরুষের চেয়ে মহিলাদের বেশি হয় ।

ইনসিশোনাল হার্নিয়াঃ এটা মূলত মহিলাদের ডেলিভারির পরে বা কিডনি স্টোন অপারেশনের পরে হয়।আম্বিলিক্যাল হার্নিয়া: এটাও মহিলাদের হয়, নাভির চারপাশে এটা হয়। নাভির চারপাশ থেকে বেরিয়ে আসে নরম মাংসপেশি

এপিগ্যাসট্রিক হার্নিয়াঃ এটা হয় পেটের উপর দিকে, খুব ছোট আকারের এই হার্নিয়া বেশ যন্ত্রণা দেয় নারী পুরুষ উভয়কেই।

লাম্বার হার্নিয়াঃ লাম্বার হার্নিয়া হয় কিডনির অপারেশনের পরে। অপারেশনের পরে জোরে কাশি হলে এই সমস্যা তৈরি হয়।

স্প্যাগেলিয়ান হার্নিয়াঃ এটা খুব কম হয়, অ্যাবডোমিনাল ক্যাভিটি থেকেই এই হার্নিয়া হয়।

প্যারাইসোফেগাল এবং ডায়াফ্রামাটিক হার্নিয়াঃ এটা হলে বুক জ্বালা, রাত্তিরে কাশির সমস্যা, গলার স্বরে পরিবর্তন দেখা যায়।

প্যারাস্টোম্যাল হার্নিয়াঃ এটার ক্ষেত্রে গ্যাস্ট্রো সমস্যা থাকলে বা স্টম্যাকের সমস্যা থাকলে সম্ভাবনা বেশি থাকে।

ডায়াস্টাসিস হার্নিয়াঃ এটা পেট কেটে যে কোনও অপারেশন হলেই হতে পারে। তাই পেট কেটে যে কোনও অপারেশনের পরে সাবধানে থাকাটা হার্নিয়া এড়াতে খুব জরুরি ।

সাদিয়া বেগম: কোনওভাবে আটকানো যায় হার্নিয়া? লাইফস্টাইল এবং খাবার দাবার কতটা দায়ী?

জাহিদুল হাসান কিরনঃ শুরুতেই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, তা ব্যথা থাক বা না থাক। লাইফস্টাইল অবশ্যই দায়ী। ওবেসিটি (মেদবুড়ি) যে কোনও ক্ষেত্রেই সমস্যা তৈরি করে। এক্ষেত্রেও আলাদা না। যত ব্যায়াম করে নিজেকে ফিট রাখবেন তত সমস্যা কম হবে।আর অপারেশনের পরে ভারী জিনিস তোলা, বেশি জোরে হাঁটা, খুব জোরে হাঁচি কাশি হার্নিয়ার সূত্রপাত করতে পারে। তাই হাল্কা খাবার খান আর রোজ কিছুক্ষণ ব্যায়াম করুন। হার্নিয়া একবার হলে অপারেশন ছাড়া গতি নেই। ওষুধে বা কোনও ঘরোয়া চিকিত্সায় সারে না এই রোগ।

সাদিয়া বেগমঃ ডায়বেটিস, হাই ব্লাড প্রেসারের রোগী বা হার্টের রোগী হলে অপারেশন করা যায়? রিস্ক থাকে কতটা?

জাহিদুল হাসান কিরনঃ এক্ষেত্রে জটিলতা বাড়ে। অপারেশনে সময় লাগে ৩ থেকে ৬ ঘণ্টা। অন্য কোনও বড় রোগ না থাকলে অপারেশনের পরে সাধারণত ৩ থেকে ৪ সপ্তাহের মধ্যেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফেরা সম্ভব। কিন্তু ডায়বেটিস, উচ্চরক্তচাপ এবং হার্টের রোগী হলে ৩ থেকে ৪ মাস সময় লাগে। অপারেশন করার আগে এ জাতীয় রোগীদের অনেক বেশি অবসার্ভেশনে থাকতে হয়। তাদের শরীরের সমস্ত দিক খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে তবে অপারেশন করা হয়। এমনকি এজাতীয় রোগীদের যদি হার্নিয়া খুব একটা সমস্যা না করে তাহলে অপারেশল করতেও বারণ করা হয়। কারণ লাইফরিস্ক অন্যদের তুলনায় এখানে বেশি থাকে।

সাদিয়া বেগমঃ হার্নিয়া হলে কী কী খাবার খেতে হবে কতটুকু পরিমান খেতে হবে?

জাহিদুল হাসান কিরনঃ খাবার তালিকায় বেশি বেশি টাটকা ফল, শাকসবজি ও মাছ রাখতে হবে। প্রতিদিন ২-৩লিটার পানি খেতে হবে।খাবারের পরিমান: সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্যায়াম করার পর ৮টা বাজে তেল ছাড়া ২টি রুটি আর সবজি, ১১টায় একটি সিদ্ধ ডিম, দুপুর ২টায় ৩-৫কাপ ভাত ২পিস মাছ, ইচ্ছামত শাক-সবজি, সাথে সালাদবিকাল ৫টায় বাদাম / সবুজ চা ২টি বিস্কুট।রাত ৮টায় ৩-৫কাপ ভাত, ২টি মাছ, ইচ্ছামত শাক-সবজি, সপ্তাহ একদিন ঘরুর/ মুরগির মাংস খেতে পারবেন ২পিস। রাত ৯টায় ২টি ফল একটি আপেল একটি কমলা লেবু

সাদিয়া বেগম: হার্নিয়া এড়াতে কী কী সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে?

জাহিদুল হাসান কিরনঃ স্বাস্থ্যসম্মত ওজন বজায় রাখতে হবে, নিয়মিত সকাল ৩০মিনিট ও বিকালে ৩০মিনিট ব্যায়াম ও পরিমিত খাবার গ্রহণ করতে হবে। তৈলাক্ত এবং চর্বি জাতীয় খাবার কমাই খেতে হবে। মেদবুড়ি থাকলে সেটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, ভারী বস্তু উত্তোলন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। করলেও উত্তোলন সময় হাঁটু ভাঁজ করে তুলতে হবে। কোনোমতেই কোমর বাঁকিয়ে তোলা যাবে না। তাড়াতাড়ি হাঁটা, দৌড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। হার্নিয়ার চিকিৎসায় পেটে অ্যাসিড তৈরি বন্ধ করে এমন ওষুধ খেতে হবে। রাত ৯টায়/১০টার মধ্যে ঘুমিয়ে যেতে হবে। হাচি কাশি হলে সিলাই এর জায়গায় হাত দিয়ে ধরে রাখতে হবে, কাশি হলে সাথে সাথে চিকিত্সা নিতে হবে। ২৪ঘন্টা বেল্ট ব্যবহার করতে হবে।

সাদিয়া বেগম: হার্নিয়া হলে অপারেশন করাটা কী বাধ্যতামূলক?

জাহিদুল হাসান কিরনঃ হ্যাঁ, হার্নিয়া অপারেশনের মাধ্যমে ঠিক না করলে এটি পেটের দেয়ালের বাইরে আটকে গিয়ে ঘায়ের সৃষ্টি করতে পারে, যাকে ইনকার্সেরেটেড হার্নিয়া বলা হয়। হার্নিয়া নিজে নিজে ভালো হয়ে যায় না। অপারেশনের মাধ্যমেই হার্নিয়া রিপেয়ার করা সম্ভব। হার্নিয়া অপারেশনের সময় শরীরের স্বস্থান থেকে বিচ্যুত অঙ্গ বা অঙ্গের কোনো অংশকে আবার এর যথাস্থানে ফিরিয়ে দিয়ে দূর্বল পারিপার্শ্বিক মাংসপেশি ও কোষকলাগুলোকে শক্ত ও টানটান করে দেওয়া হয়। ছোট আকারের হার্নিয়া অপারেশন করে ঠিক করা একটি বড় আকারের হার্নিয়া অপারেশনের চেয়ে কম জটিল। কাজেই হার্নিয়া অপারেশন করে না ফেলে অপারেশন বিলম্বিত করলে, উপসর্গগুলো আরও অবনতি হতে পারে। অপারেশন দ্রুত করে ফেললে আপনার কর্মব্যস্ত দিনগুলো বা অবসরের সময় অকারণে নষ্ট হবে না।

সাদিয়া বেগমঃ হার্নিয়া অপারেশন কী পেট না কেটে করা যায়?

জাহিদুল হাসান কিরন: হার্নিয়া অপারেশন পেট না কেটে ল্যাপারোস্কোপির মাধ্যমে করা যায়, যাতে রোগী অনেক দ্রুত সময়ে সুস্থ হয়ে কর্মক্ষম জীবনে ফিরে আসা সহজ হয়।

হার্নিয়ার লক্ষণ দেখা দিলেই দ্রুত একজন সার্জারী ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন।

লেখক: জাহিদুল হাসান কিরন

0 Shares:
You May Also Like
Read More

ফার্স্ট এইড বক্স

★★প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয় উপকরণ:ফার্স্ট এইড কিট★★ বিপদ কখনো বলে কয়ে আসেনা। তাই সাবধানতার অংশ হিসেবে প্রতিটি বাড়িতেই ফার্স্ট…