IBS( Irritable Bowel Syndrome )

আইবিএস একটি অস্বস্তিকর পেটের পীড়া

ইংরেজি পরিভাষায় পেটের পীড়া আইবিএস হচ্ছে ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম। ইংরেজিতে সিনড্রোম শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে একটি রোগের বিভিন্ন উপসর্গ বা লক্ষণের সমষ্টি। তাই আইবিএসকে পেটের কয়েকটি উপসর্গ বা লক্ষণের সমন্বয়ে সংজ্ঞা হিসেবে ধরা হয়। এ রোগে পেট অধিকতর স্পর্শকাতর হয় বলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ক্রিয়াশীল হয়ে থাকে। পাশ্চাত্য দেশে প্রতি ১০ জনে অন্তত একজন মানুষ এ রোগে তার জীবদ্দশায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। নাটোরের একটি গ্রামে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, প্রতি ১০০ জন পুরুষে ২০ দশমিক ৬ জন এবং ১০০ জন নারীর মধ্যে ২৭ দশমিক ৭ জন এ রোগে আক্রান্ত হন।

🟤 আইবিএস কেন হয়:
আজ পর্যন্ত এ রোগের প্রকৃত কারণ জানা যায়নি। অনেক কারণে এ রোগ হয় বলে চিকিৎসার অন্তর্নিহিত কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। এখন পর্যন্ত কেবল উপসর্গের চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে ভালো রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিভিন্ন কারণের মধ্যে খাদ্যনালির অতি সংবেদনশীলতা, পরিপাকতন্ত্রের নাড়াচাড়ার অস্বাভাবিকতা বা অন্ত্র থেকে মস্তিষ্কে পাঠানো বার্তায় ত্রুটির কারণে আইবিএসের লক্ষণগুলো দেখা দেয়। এ ছাড়া স্নায়ুর চাপ এবং দুশ্চিন্তা, খাদ্যাভ্যাস, অন্ত্রের প্রদাহ এবং সংক্রমণ, হরমোন (নারীদের মাসিকচক্রের সঙ্গে), মাদক গ্রহণ, বংশগত কারণ, পেটের যেকোনো অপারেশন ও দীর্ঘকাল ধরে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের কারণে আইবিএসের সমস্যাকে বাড়িয়ে দেয়।

🟤 উপসর্গ:
পেটব্যথা, পেটফাঁপা, পায়খানার সঙ্গে আম যাওয়া, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া ও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমন্বয় ইত্যাদি। কোনো রোগীকে আইবিএস হিসেবে শনাক্ত করতে হলে এ লক্ষণগুলোতে অন্তত দুটি লক্ষণ তিন মাস পর্যন্ত উপস্থিত থাকতে হবে। এ ছাড়া অন্য যেসব লক্ষণ থাকতে পারে, সেগুলো হলো—পেটে অত্যধিক গ্যাস, পেটে অত্যধিক শব্দ, বুক জ্বালা, বদহজম, পায়খানা সম্পূর্ণ না হওয়া, পেটে ব্যথা হলে টয়লেটে যাওয়ার খুব তাড়া, পেটব্যথা হলে পাতলা পায়খানা হওয়া, শারীরিক অবসাদ ও দুর্বলতা, মাথাব্যথা, পিঠে ব্যথা, কোমরে ব্যথা, ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ, নারীদের ক্ষেত্রে মাসিক চলাকালীন কিংবা মিলনের সময় ব্যথা। কিন্তু যদি পায়খানার সঙ্গে রক্ত পড়ে, শরীরের ওজন কমে যায় এবং হঠাৎ পায়খানার ঘনত্বের পরিমাণ কমে যায়, তবে এগুলো অন্য কোনো রোগের এমনকি কোলোরেকটাল ক্যানসারের উপসর্গও নির্দেশ করে। এ অবস্থায় অতিসত্বর কোনো গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে।

🟤রোগ নির্ণয়:
এ রোগ সাধারণত উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে নির্ণয় করা হয়। রোগীর বয়স ও সুনির্দিষ্ট লক্ষণের ওপর নির্ভর করে এক বা একাধিক পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। ৪০ বছরের কম বয়সী রোগীদের ক্ষেত্রে লক্ষণের ওপর নির্ভর করে রোগ শনাক্ত করা যায়। বয়স ৪০ বছরের ওপরে হলে কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। তবে আইবিএস রোগীর ক্ষেত্রে এসব পরীক্ষার ফলাফল স্বাভাবিক থাকবে। পরীক্ষাগুলো হলো-

১. রক্ত পরীক্ষা, ২. মল পরীক্ষা, ৩. পেটের এক্স-রে, ৪. বেরিয়াম এনেমা, ৫. প্রক্টোসিগময়ডোস্কপি/কোলোনোস্কপি

আইবিএস ঝুঁকিপূর্ণ রোগ নয়, সংক্রামক রোগও নয়, এমনকি বংশগত রোগও নয়। এ রোগ অন্ত্রের ক্যানসার কিংবা অন্য কোনো ক্যানসারের কারণ নয়, এ কথাগুলো রোগীর চিকিৎসা শুরুর আগে রোগীকে ভালো করে বুঝতে হবে। প্রথমেই রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে নিতে হবে। তাহলেই এ রোগের চিকিৎসায় ভালো ফল পাওয়া যাবে। রোগীর উপসর্গ কমে না বলে রোগী ঘন ঘন চিকিৎসক পরিবর্তন করেন। ঘন ঘন চিকিৎসক পরিবর্তন করলেই ভালো ফল লাভ করা যাবে না, এ কথা রোগীকে বুঝতে হবে। বিদেশি সমীক্ষায় দেখা গেছে, আইবিএস রোগীদের মধ্যে ১০ শতাংশ চিকিৎসকের কাছে যান। অধিকাংশ রোগী সামান্য ব্যবস্থায়ই উপশম লাভ করেন। কিন্তু তাঁদের ২৫ শতাংশ রোগীর উপসর্গের কোনো পরিবর্তন হয় না। এমনকি তাঁদের অবস্থা আগের চেয়েও খারাপ হতে পারে।

🟤চিকিৎসা:
বর্তমানে আইবিএসের চিকিৎসা উপসর্গভিত্তিক এবং চিকিৎসা মূলত নির্ভর। ডায়রিয়াপ্রবণ আইবিএস (IBS-D), কোষ্ঠকাঠিন্যপ্রবণ আইবিএস (IBS-C) ও উভয় লক্ষণ থাকলে (IBS-M) সে অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হয়। আইবিএস চিকিৎসায় কোনো একক ওষুধ সম্পূর্ণরূপে কার্যকরী নয়।

১. প্রথমত, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। দুধ ও দুধজাতীয় খাবার রোগীর উপসর্গ বাড়িয়ে দেয়। তাই এগুলো পরিহার করতে হবে। খাবার খাওয়ার সময় লক্ষ করুন কোন খাবারগুলো আপনার উপসর্গ বাড়িয়ে দেয়, সেগুলো পরিহার করুন।

২. মানসিক চাপ কমাতে হবে। এমনকি মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। ব্যায়াম করতে পারেন অথবা মনকে আনন্দ আর প্রশান্তি দিতে পারে এমন কিছু করতে পারেন। রিলাক্সেশনথেরাপির মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানো যেতে পারে।

৩. আইবিএসডির ক্ষেত্রে লোপেরামাইড, ডাইফেনোঅক্সালেট, অক্সিফেনোনিয়াম প্রভৃতি ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এ ওষুধগুলো অন্ত্রের নাড়াচাড়া কমানোর মাধ্যমে কাজ করে।

৪. আইবিএসসির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের লেক্সোটিভ-জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। ইসবগুলের ভুসি ও অন্য আঁশ এ ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

৫. যেসব রোগীর ক্ষেত্রে পেটে ব্যথা, আইবিএসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপসর্গ সে ক্ষেত্রে অ্যান্টিস্পাসমোডিক্স-জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এগুলো অন্ত্রের সংকোচন কমানোর মাধ্যমে কাজ করে।

আইবিএস রোগীদের সুস্থ থাকতে হলে ওষুধ ব্যবহারের আগে গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্টের পরামর্শ নিতে হবে

🟤 আইবিএস থেকে হতে পারে ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য

আইবিএস বা ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রম অন্ত্র ও পরিপাকতন্ত্রের একটা জটিল সমস্যা । এ রোগের উপসর্গগুলোও নানাবিধ। অন্ত্রের অন্যান্য সমস্যা-যেমন প্রদাহজনিত অন্ত্রের সমস্যা বা অন্ত্রের ক্যান্সারের সাথে আইবিএসের উপসর্গসমূহের কদাচিত্ মিল খুঁজে পাওয়া যায় । তবে আইবিএস থেকে এ জাতীয় রোগের সৃষ্টি হয় না।

🟤কোন বয়সে হয়:
১৮-৪০ বছরের মহিলা ও পুরুষের মধ্যে এ রোগের লক্ষণসমূহ পরিলক্ষিত হয় । পুরুষের তুলনায় মহিলারা এ রোগে বেশী ভুগে থাকেন।

🟤উপসর্গসমূহ:

পেট ব্যাথা: যা মলত্যাগ বা বায়ু নিরসণের পর কমে যায় ।

২. খাবার পর পেট ফুলে যাওয়ার অনুভূতি (Bloating)

৩. ডায়রিয়া- সাধারণতঃ সকালে মলত্যাগের সময় হয়ে থাকে ।

৪. কোষ্ঠকাঠিন্য – মল অত্যন্ত শক্ত অথবা ছোট ছোট পিন্ড হয়ে বের হয় । অধিকাংশ ক্ষেত্রে মলত্যাগের সময় চাপ প্রয়োগ করতে (কোত্ দিতে) হয়। কোনো কোনো রোগীর ডায়রিয়া এবং কোষ্ঠকাঠিন্য পর্যায়ক্রমে (Alteately) হয়ে থাকে।

৫. পিচ্ছিল পদার্থ বা চর্বিযুক্ত মল ।

৬. মলত্যাগের পরেও মনে হয় আবার মলত্যাগ করতে হবে (Incomplete Evacuation) ।
যে সমস্ত উপসর্গ আইবিএসের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়

ক্ষুধামন্দা, বমি বা বমিভাব, ঢেকুর ওঠা, মাথাব্যথা , ঘাম হওয়া, অনিদ্রা, জ্ঞান হারানো, রক্তমিশ্রিত মলত্যাগ-এগুলো লক্ষণ নয় ।

🟤উপসর্গের ধরন

ব্যক্তিবিশেষে IBS  এর উপসর্গগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে । উপসর্গগুলো কয়েক দিন,কয়েক সপ্তাহ,কয়েক মাসও স্থায়ী হতে পারে । যদিও উপসর্গগুলো বেশির ভাগ সময় পর্যায়ক্রমে ঘটে থাকে । যেমন-ডায়রিয়া পরবর্তী কোষ্ঠকাঠিন্য বা বিপরিতক্রমে উপসর্গগুলো প্রকাশ পায় । পেটের ব্যথা (মাঝারি অথবা অসহ্য ব্যথা) কোন নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে হয় না তবে ঘুমন্ত অবস্থায় কখনই এ ধরনের ব্যথা পরিলক্ষিত হয় না ।

🟤 মানসিক চাপের সাথে সম্পর্ক

সহনীয় পর্যায়ের মানসিক চাপ মানুষকে উদ্বিগ্ন করে। তবে অত্যাধিক মানসিক চাপ মানুষকে বিষাদগ্রস্থ করার ফলে এসব উপসর্গ গুলো বৃদ্ধি পায়। সমস্যাটা হলো বিষন্নতার কারণে অন্যসব বিষয়ের পাশাপাশি মানুষ অন্ত্রের (মলত্যাগের) বিষয়েও তখন দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে ফলে অন্ত্রের সমস্যা তৈরী হয় আবার অন্ত্রের সমস্যাও মানুষকে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তোলে ।

IBS থেকে মুক্তি পেতে মানসিক চাপ কমানো প্রয়োজন , দৈনন্দিন জীবনে মানসিক চাপকে এড়ানো যায় না তবে আয়ত্তের মধ্যে রাখা সম্ভব । মানসিক চাপ কমানোর জন্য ব্যায়াম করুন । ব্যায়াম করার সময় মানসিক চাপ অনেকটাই কমে আসে ।

🟤 খ্যাদ্যাভ্যাস:
আঁঁশযুক্ত খাবার IBSকে প্রতিহত করে। তাই ধীরে ধীরে আঁঁশযুক্ত খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। শাকজাতীয় খাবার বা যে সমস্ত খাবার গ্যাস উদ্রেক করে তা পরিহার করুন । দুধজাতীয় খাবার অনেকের হজম হয় না, গ্যাস উদ্রেক করে বা প্রচুর বায়ু নিঃসরন করে থাকে। তাদের ক্ষেত্রে ল্যাকটোজ ইনটলারেন্সও (দুগ্ধ জাতীয় খাবার হজমে সমস্যা) থাকতে পারে ।

🟤 ঔষধ:
উপসর্গগুলো কমানোর জন্য বাজারে নানা ধরনের ঔষধ আছে তবে তা কখনই চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত খাওয়া ঠিক নয়।

১. মনে রাখবেন যে কোন ঔষধ খাওয়ার আগে আপনার রোগ সম্পর্কে চিকিৎসককে জানানো বাঞ্ছনীয় ।

২. আপনার চিকিৎসকই আপনার রোগ নির্ণয় করে যথাযথ পরামর্শ/ঔষধ দিয়ে থাকেন ।

৩. এটি একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ ।

🟤আইবিএসের রোগীদের জন্য ক্ষতিকর ছয় খাবার

ইরিটেবল বাউয়েল সিনড্রম বা আইবিএস দীর্ঘমেয়াদি পেটের পীড়াজনিত রোগ। মূলত এটি খাদ্যনালির একধরনের সমস্যা। মাঝে মাঝে পেট ব্যথা, পেট ফাঁপা, মলত্যাগের ধরন পাল্টে যাওয়া (কখনো পায়খানা বেশি নরম হওয়া অথবা বেশি শক্ত হয়ে যাওয়া) ইত্যাদি আইবিএসের কিছু লক্ষণ।

কিছু খাবার আইবিএসের সমস্যাকে আরো শোচনীয় করে তোলে। আইবিএসের রোগীদের জন্য ক্ষতিকর কিছু খাবারের নাম জানিয়েছে জীবনধারা বিষয়ক ওয়েবসাইট বোল্ডস্কাই।

১. পাস্তা: পাস্তা, পিৎজা- এ জাতীয় খাবারে উচ্চ পরিমাণ গ্লুটেন রয়েছে। গবেষণায় বলা হয়, গ্লুটেন আইবিএসের অবস্থাকে আরো খারাপ করে দেয়।

২. দুগ্ধ জাতীয় খাবার: দুগ্ধ জাতীয় খাবার খেলে অনেক সময় আইবিএসের সমস্যা বেড়ে যায়। যেমন : দুধ , মাখন, পনির ইত্যাদি। দুধে থাকা ল্যাকটোজ থাকার কারণে এই ধরনের সমস্যা হয়।

৩. ভাজা খাবার: আইবিএসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য ভাজা খাবার অস্বাস্থ্যকর। ক্ষতিকর তেল ও চর্বি ডাইজেসটিভ ট্র্যাক্টে সমস্যা করতে পারে।

৪. কফি: কফি, এনার্জি ড্রিংকস, চা ইত্যাদি আইবিএস রোগীদের জন্য ক্ষতিকর। ক্যাফেইন অন্ত্রে উদ্দীপনা তৈরি করে ডায়রিয়া বাড়িয়ে তোলে।

৫. প্রক্রিয়াজাত খাবার: প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফ্রোজেন খাবার, ফাস্ট ফুড ইত্যাদির মধ্যে রয়েছে প্রিজারভেটিভ। প্রিজারভেটিভ আইবিএসে আক্রান্ত রোগীদের অন্ত্রে পুনরায় প্রদাহ তৈরি করতে পারে।

৬. মদ্যপান: মদ্যপান শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আইবিএসের রোগীরা এটি খেলে অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই মদ্যপান এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।

🟤আইবিডি বা ইনফ্লেমেটরী বাওয়েল ডিজিজ

দীর্ঘমেয়াদী আমাশয়ের সমস্যার মধ্যে অন্যতম প্রধান হল, ইনফ্লেমেটরী বাওয়েল ডিজিজ তথা আইবিডি। আইবিডির মধ্যে দুটো রোগকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে: ক্রনস ডিজিজ ও আলসারেটিভ কোলাইটিস। রোগ দুটোতে খাদ্যনালীর আক্রান্ত স্থান, আক্রান্তের ধরন ও প্রকৃতি,খাদ্যনালীর বাইরে সমস্যার উপস্থিতি ও চিকিত্সার ধরনের পার্থক্য আছে। আইবিডি একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা যা বছরের পর বছর চলতে থাকে এবং হঠাৎ হঠাৎ বেড়ে যাওয়া ও কমে যাওয়ার আচরণ দেখায়। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে ক্রনস ডিজিজ-এর চেয়ে আলসারেটিভ কোলাইটিস বেশী হচ্ছে। ওষুধ খেয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখলে আইবিডির রোগীদের আয়ু সাধারণ মানুষের গড় আয়ুর সমানই হয়। লক্ষণীয়, স্বল্পমেয়াদী ব্যাকটেরিয়া জনিত আমাশয়েও রক্ত যায়, কিন্তু এর সাথে আলসারেটিভ কোলাইটিসের পার্থক্য হল যে, পরেরটি দীর্ঘমেয়াদী। অধিকাংশ রোগীর ওজন ঠিক থাকে। কারও কারও জ্বর, শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা ও পেটে অশ্বস্তি লাগার সমস্যা হতে পারে। ক্রনস ডিজিজের মূল সমস্যা হলো আমাশয়, পেটে ব্যথা এবং ওজন কমে যাওয়া। খাওয়ার সাথে ওজন কমে যাওয়ায় রোগী খেতে পারে না। ফলে ধীরে ধীরে ওজন কমে যেতে থাকে এবং ভিটামিনের অভাব থেকে রক্তশূন্যতা, রক্তে তারল্য বৃদ্ধি, স্নায়ুতে সমস্যা ইত্যাদি হতে পারে। কারও কারও পায়খানার সাথে বমি ও মুখে ঘা হতে পারে।

আলসারেটিভ কোলাইটিস ও ক্রনস ডিজিজ উভয় রোগেই অন্ত্রনালীর বাইরে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন: কনজাঙ্কটিভাইটিস, আইরাইটিস ইত্যাদি চোখের সমস্যা, ফ্যাটিলিভার, পিত্তথলীর পাথর ও প্রদাহ, গিড়ায় ব্যথা, চর্মরোগ ইত্যাদি। সুতরাং দীর্ঘমেয়াদী আমাশয়ের, পাশাপাশি এ জাতীয় সমস্যাগুলো থাকলে চিকিৎসকরা আইবিডির ব্যাপারে সন্দেহ করেন।

আইবিডি রোগ নির্ণয় করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। এর মধ্যে আছে: অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে পায়খানার পরীক্ষা ও কালচার স্টাডি, এন্ডোস্কপি, কলোনস্কপি, ব্যারিয়াম এনেমা।

আইবিডি রোগটি যেমন দীর্ঘমেয়াদী এর চিকিতৎসাও দীর্ঘমেয়াদী। আইবিডির চিকিৎসায় দীর্ঘদিন স্টেরওয়েড, স্যালাজিন, মিথোট্রিক্সেট, সাইক্লোস্পরিন, এন্টাই টিএনএফ ইত্যাদি শক্তিশালী ওষুধ ব্যবহার করতে হয়। এ জন্য এ রোগের চিকিৎসা নিয়মিত চিকিৎসকের সান্নিধ্যে থেকে করতে হয়। তদুপরী যাদের ৮ বছরের বেশী সময় ধরে আইবিডি রোগ থাকে তাদের অন্ত্রে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ কারণে এ রোগের ব্যাপারে অবহেলা করার ন্যূনতম সুযোগ নেই।

🟤পরিশেষে

আমরা এই প্রবন্ধটির মধ্য দিয়ে মানবদেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কমন একটি সমস্যা সম্পর্কে জানতে পারলাম। যেহেতু আমাশয় স্বল্পমেয়াদী থেকে দীর্ঘমেয়াদী যে কোন রকম হতে পারে এবং এদের চিকিৎসার ধরনও ভিন্ন, সেহেতু আমাদের উচিত এ রোগগুলোর ব্যাপারে নিজেরা সচেতন থাকা এবং আমাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজনদের সচেতন করে চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহিত করা। পাশাপাশি, যাদের দীর্ঘদিন অথবা ঘন ঘন পেটের অসুখের সমস্যা হয় তাদের লিভারের কোন সমস্যা আছে কিনা তা নির্ণয় করে নেয়া দরকার। কেননা, যদি লিভারে প্রদাহ থাকে এবং তা প্রাথমিক পর্যায়েই নির্ণয় করা যায় তাহলে নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণ করে লিভার সিরোসিস নামক জটিল সমস্যাও প্রতিরোধ করা যেতে পারে।

[১] অধ্যাপক ডা. সুসেন কুমার সাহা , গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
[২] ডা. আহমেদউজ জামান, এমববিবিএস, এমএস, এফআইসিএস (ইউএসএ), পিএইচডি সহযোগী অধ্যাপক
[৩] অধ্যাপক ডা. মবিন খান

1 Shares:
Leave a Reply
You May Also Like

দই

দই বলতে আমরা মূলত বুঝি মিষ্টি বা টক-মিষ্টি দই। কিন্তু স্বাদের দিক থেকে একটু কম হলেও টকদই আমাদের…