সেক্স_এডুকেশনঃ কি শেখাবো, কখন শেখাবোঃ
পর্ব_২ঃ
এর আগের পর্বে লিখেছিলাম ০-৩ বছরের বাচ্চাদের কি শেখাবেন, আজ লিখছি বাকিটুকু।
৩-৮ বছরঃ
আসলে অনেক বাচ্চা ২ বছরের পরেই অনেক কিছু বুঝতে শিখে যায়, তাদের প্রাইভেসি জ্ঞান প্রকট থাকে। ওই সময় থেকেই তাদের শেখাতে হবে আড়ালে কাপড় বদলানো, নিজের লজ্জাস্থান নিজের পরিস্কার করতে শেখা, নিজের জামা কাপড় নিজের পরতে শেখা, দরজা বন্ধ করে গোসল ও ওয়াশরুমে যাওয়া, জনসম্মুখে প্রাইভেট পার্টস স্পর্শ না করা, গুড টাচ, ব্যাড টাচ এসব।

অনেক বাচ্চা অন্য বাচ্চাদের দেখলে জড়িয়ে ধরতে বা চুমু খেতে যায়। এটা খারাপ কিছু নয়, তবে তাকে শেখাতে হবে জড়িয়ে ধরার আগে পারমিশন নিতে হয়, আর অন্য বাচ্চাটার ভালো না লাগলে সরে আসতে হবে।
গুড টাচ, ব্যাড টাচ কিভাবে শেখাবেন- বলতে পারেন জামার নিচে ঢাকা বডির যেকোনো স্থানে বাবা মা ব্যতীত অন্য কেউ ধরলে জোরে নো বলতে হবে এবং চিৎকার করে বাবা মায়ের কাছে সাহায্যের জন্য দৌড় দিতে হবে। কেউ জোর করে চুমু খেতে চাইলে বা জড়িয়ে ধরতে চাইলেও একই কাজ করতে হবে। কারো কোলে বসতে উৎসাহ দিবেন না।
বাচ্চাদের এটাও জানিয়ে রাখতে হবে এমন কোনো কথা কেউ যদি বলে যে – এটা তোমার আমার সিক্রেট, বা কাউকে বলবে না / বাবা মা কে বললে অনেক খারাপ হবে – সেসব কথা সেসব সিক্রেট অবশ্যই যেনো নির্দ্বিধায় বাবা মায়ের কাছে প্রকাশ করে, যাতে তারা বাচ্চাটিকে সাহায্য করতে পারেন।
এই সময়টার মধ্যে বাচ্চাদের মধ্যে আরেকটা ধরণ কারো কারো প্রকাশ পায়, যেটা বাবা মায়েরা আগে থেকে লক্ষ্য করলে পরবর্তীতে বাচ্চাটিকে স্বাভাবিক জীবন দেয়া সম্ভব। তা হলো আমরা যাদের হিজড়া বলি। এই সময়ই তাদের কিছু স্বভাব প্রকাশ পেতে থাকে। যদি বাহ্যিক আচরণ ছেলেদের মত বা স্বভাব মেয়েদের মতো এমন কোনো চিহ্ন প্রকাশ পায় অবশ্যই শারিরীক ও হরমোনাল পরীক্ষা করিয়ে চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে শিশুটিকে স্বাভাবিক জীবন যাপনের ব্যবস্থা করে দেয়া উচিত।
বাচ্চাদের ধীরে ধীরে ধর্মীয় অনুশাসনের সাথে পরিচয় করানো উচিত। শুধু ভয় দেখিয়ে নয়, আমাদের ভালোর জন্য কেনো আমরা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলবো সেসব বোঝানো উচিত।
বাচ্চারা কি খেলছে, কাদের সাথে খেলছে সেগুলো নিয়ে ধারণা রাখবেন। বাচ্চাদের বর/বউ খেলা বা বয়ফ্রেন্ড/গার্লফ্রেন্ড খেলা কে নিরুৎসাহিত করুন। বাচ্চাদের স্কুল থেকে আসার পর, বা কোথাও আপনাকে ছাড়া বেড়াতে গেলে সেখানে কি হয়েছিল, কার কার সাথে দেখা হয়েছিল, কি খেলা খেলেছিল এসব জানতে চাবেন বন্ধুর মতো করে। গোয়েন্দা তদন্তের মতো করে নয়।

৮-১৫ বছরঃ
এই সময়ের কিছু পরেই বাচ্চাদের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন আসা শুরু হয়। তাই তাদের পিরিয়ড, পিরিয়ডের সময় নিজেদের কিভাবে যত্ন নিতে হবে, পিরিয়ডের সময় কি কি সমস্যা হতে পারে ও কিভাবে সমাধান করা যেতে পারে, হরমোনাল পরিবর্তন আসে এবং সেগুলোর জন্য শরীরে কি কি পরিবর্তন আসতে পারে, ছেলেদের দাঁড়ি-গোঁফ আসতে পারে, কন্ঠস্বরের পরিবর্তন আসতে পারে, লিঙ্গ উত্থান, স্বপ্ন দোষ, হেয়ার গ্রোথ এসব হতে পারে। এগুলো নিয়ে তাই আগে থেকে ধারণা না দিলে নানা মুনির নানা মত মিলে জগা খিচুড়ি পেকে যায়।
এবং সেই যে পারমিশন ছাড়া কাউকে স্পর্শ করবেও না আর কাউকে স্পর্শ করতে দিবে ও না এই কথাগুলো বার বার তাদের মনে করিয়ে দিতে হবে।
তাদের পারিবারিক জীবন এবং পারিবারিক জীবনের গুরুত্ব এসব সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে।
এসময় যেহেতু বাচ্চারা সত্যি মিথ্যে রিলেট করা শিখে যায়, তাই তারা যেই প্রশ্ন ই করবে একটু বুদ্ধির সাথে সঠিক উত্তর শালীন ভাষায় দেয়ার চেষ্টা করতে হবে।
১৫-১৮ বছরঃ
কঠিন সময় বাবা- মায়েদের জন্য। টিন এজ বয়সের বালাই লেগে যায় এসময়। আপনি এতোগুলো বছর কিভাবে বোঝাতে পেরেছেন, শেখাতে পেরেছেন অনেকটাই তার উপর নির্ভর করে আবার করে ও না। তারা নতুন কিছু জানার ও করার প্রতি দুর্বার নেশায় অনেক ভুল করে বসে। তাই ভুল হবার আগেই শিক্ষা দেয়াটা জরুরি।
নারী পুরুষের স্বাভাবিক সম্পর্ক, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন, বিয়ের গুরুত্ব, লজ্জাস্থানের হেফাজত, নম্রতা ও নমনীয়তা এসব নিয়ে বিস্তারিত বোঝাতে হবে। এর সাথে অবশ্যই সেই গুড টাচ, ব্যাড টাচ আগের মতোই বাবা মায়ের কাছে লুকানো যাবে না – সেসব ও বোঝাতে হবে। এর সাথে সাথে এই সময় থেকেই নারী পুরুষের স্বাভাবিক সম্পর্কের মাধ্যমে বাচ্চা তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাদের ধারণা দিতে হবে, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, যৌন রোগ এসব নিয়েও ধারণা দিতে হবে।
এবয়সে আপনি যখন জ্ঞান দিতে যাবেন, স্বাভাবিক ভাবেই বাচ্চারা আগ্রহী থাকে না শোনার জন্য। সেক্ষেত্রে বাচ্চাদের সাথে ওপেন ডিসকাশন করা যায়, যেমন তুমি কি ভাবো এই বিষয়টি নিয়ে বা তোমার মতামত কি- এভাবে শুরু করলে আলোচনা করাটাও সহজ হয়ে যায় এবং তারাও নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে পারে।
বয়স ভেদে আলোচনাগুলোর উপস্থাপন কিন্তু আপনাদের নিজেদের বুঝে নিয়ে করতে হবে। একেক বয়সে বাচ্চাদের সামনে একেক ভাবে বিষয় গুলো তুলে ধরতে হবে। আপনাদের উপস্থাপন প্রক্রিয়ার উপর তাদের প্রয়োগ প্রক্রিয়া নির্ভর করে। তাই বাচ্চাদের সামনে এগুলো আলোচনার আগে নিজেদের প্রস্তুত করে নিন কিভাবে এই আলোচনা করবেন,কি শব্দ প্রয়োগ করবেন। আর এগুলো একটি সিরিয়াস বিষয়, দয়া করে এগুলো নিয়ে হাসি ঠাট্টা মশকরা করে বাচ্চাদের মনে এগুলোর সিরিয়াসনেস নস্ট করবেন না।
আমাদের দেশে একেবারেই এই সেক্স এডুকেশন নিয়ে বাচ্চাদের ধারণা না দেয়ার কারণে যে সমস্যাটা হয়, তারা মুভি দেখে, পর্ণ দেখে, বন্ধুদের বা বিভিন্ন জনের কাছ থেকে অবাস্তব, অসত্য কিছু তথ্যের ভিত্তিতে নিজ থেকে ভুল বয়সে ভুল পদ্ধতিতে বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট চালাতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়। অপ্রাপ্ত বয়সে যৌন সম্পর্কের কারণে কি কি ক্ষতি হতে পারে তাদের সে ধারণা দিতে হবে।
সেক্স এডুকেশন দেয়া মানে তাদের সেক্স শেখানো নয় বরং তাদের যেনো নৈতিকভাবে, সামাজিক ও পারিবারিক ভাবে কোনো ক্ষতি না হয় তা শিক্ষা দেয়া।
আশা করি অনেকের কাজে আসবে লেখাটি। আর সবার প্রতি একটি অনুরোধ থাকবে, শিশুদের শিশু হয়ে থাকতে দিন। ছোট ছোট বাচ্চা গুলোকে নায়ক নায়িকার ঢঙে সাজাতে গিয়ে, নাচাতে গিয়ে ওদের শিশু সুলভ মনের বারোটা বাজাবেন না। সেক্স এডুকেশন দিলে বাচ্চারা নস্ট হয় না, নস্ট হয় পাকনামো দেখে, পাকনামো করে। সবার প্রতি শিশু বান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার অনুরোধ রইলো। ধন্যবাদ।
(চলবে)
ডাঃ তাজরীন জাহান
Advisor
20 Minute Medical